পঞ্চগড় জেলা কারাগারে আইনজীবি পলাশ কুমার রায়ের হত্যার বিচারের দাবীতে জাগো হিন্দু পরিষদ চট্টগ্রাম জেলার অায়োজনে মানববন্ধন কর্মসূচি হয় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব এর সামনে৷
এতে বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা উপস্থিত হয়ে পলাশ রায়ের হত্যা মামলার সুষ্ঠু বিচারের দাবী তুলেন৷
উল্লেখ্য যে, পঞ্চগড় জেলা কারাগারে আইনজীবী পলাশ কুমার রায়ের (৩৬) গায়ে আগুন দেওয়া হয়েছিল বলে স্বজনদের কাছে তার মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে স্পষ্ট। তবে পঞ্চগড় জেলা কারাগার দাবি করেছে, এই অডিও কারসাজি করে বানানো। নিহত আইনজীবীর পরিবারের দাবি, পলাশকে হত্যা করা হয়েছে। মৃত্যুর আধাঘণ্টা আগে ৩০ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে পলাশের ভাগ্নে (বোনের ছেলে) প্রসেনজিৎ সরকার রায় ও ছোট ভাই অমিয় কুমার রায় তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। মৃত্যুর আগে জবানবন্দিতে পলাশ অভিযোগ করেছেন- তার গায়ে দুজন ব্যক্তি আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
মৃত্যুর আগে পলাশ যা বলেন
মৃত্যুর আধাঘণ্টা আগে আইনজীবী পলাশ কুমার রায় তার বোনের ছেলে প্রসেনজিৎ কুমার রায়কে বলেন, ‘রেকর্ডটা অন করো। আমি কিছু কথা বলতে চাই।’ এরপর প্রসেনজিৎ তার মোবাইলে রেকর্ড অন করলে ৫ মিনিট ৭ সেকেন্ড কথা বলেন পলাশ। রেকর্ডে তিনি দাবি করেন জেলখানার ভেতরে তার গায়ে আগুন দেওয়া হয়েছে।
কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানিতে ২০১৩ সালে আইন কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন পলাশ কুমার রায়। এই কোম্পানি থেকে ইস্তফা দেন ২০১৬ সালে। পলাশ মৃত্যুর আগে রেকর্ড করা অডিওটিতে দাবি করেন, ‘কোহিনূর কোম্পানির মালিক তাকে দিয়ে ভুয়া দলিল এবং অন্যায় কাজ করতে বলেন। কিন্তু তিনি এই অবৈধ কাজকে সমর্থন করতে না পেরে চাকরি ছেড়ে দেন।’
তিনি অডিওতে বলেন, ‘আমি ২০১৩ সালে কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানিতে আইন কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেই। এরপর ২০১৬ সালে কোহিনূর কোম্পানির মালিক আমাকে দিয়ে ভুয়া দলিল, অন্যায় এবং অবৈধ কাজ করার জন্য নির্দেশনা দিলে আমি সেটা করিনি বলে আমি চাকরি থেকে ইস্তফা দেই। পরবর্তী সময়ে অনেক ঘটনাই ঘটে। ২০১৬ সালে আমি সে কোম্পানি থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর আমার নামে ৩১ লাখ টাকা আত্মসাতের মিথ্যা মামলা করে। কোহিনূর কোম্পানির অবৈধ কাজগুলোতে সহায়তা করে সরকারের প্রভাবশালী অনেক কর্মকর্তা।’
সর্বশেষ চলতি বছরের ২৫ মার্চ পঞ্চগড়ে একটি মানববন্ধন করেন পলাশ। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় যাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় পলাশ মামলা থেকে রেহাই পান। মানববন্ধনের পর পলাশের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার অপরাধে একটি মামলা করা হয় পঞ্চগড়ে। এই মামলায় তাকে পঞ্চগড় জেলে পাঠানো হয়। জেলে থাকা অবস্থায় জেলখানার ভেতরে পলাশকে হয়রানি ও হুমকি দেওয়া হয়। এই হুমকির কথা পঞ্চগড় জেলারকে জানান বলে অডিওতে দাবি করেন পলাশ।
তিনি বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ২৫ মার্চ পঞ্চগড়ে মানববন্ধন করি। উল্টো আমার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তির অপরাধে মানহানির মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। এরপর আমাকে পঞ্চগড় জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন ব্যক্তি আমাকে হয়রানি করে, হুমকি দেয়, ছবি তোলে। আমি জেলার সাহেবকে বলি। কিন্তু পঞ্চগড়ের জেলার সেটি গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো ক্ষমতাশালীদের পক্ষ নেয়।’
২৬ এপ্রিল কারাগারের ভেতরে দুজন ব্যক্তি বোতল থেকে কিছু একটা তার ওপর ছুড়ে মেরে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে দাবি করেন পলাশ কুমার রায়। তিনি বলেন, ‘২৬ এপ্রিল, শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে দুজন লোক টাইগার বোতল থেকে কী যেন ছুড়ে আমার শরীরে আগুন লাগিয়ে আমার জীবনকে মৃত্যুর মুখোমুখি ঠেলে দেয়। এই অপরাধীদের বিচার চাই।’
পলাশের বক্তব্য রেকর্ড করার বিষয়ে তার বোনের ছেলে প্রসেনজিৎ কুমার রায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৩০ এপ্রিল মারা যাওয়ার ঠিক আধাঘণ্টা আগে আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) এর ভেতরে তার বক্তব্য রেকর্ড করি। ওইদিন দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে তিনি মারা যান। তখন মামার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো খুব। কী মনে করে যেন বলছিলেন, রেকর্ডটা অন করো, আমি কিছু কথা বলবো।’
আইনজীবী পলাশ কুমার রায় তার বিরুদ্ধে একটি কেমিক্যাল কোম্পানির করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গত ২৫ মার্চ অনশন ও মানববন্ধন করেন। ওইদিন বিকালে প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননার অভিযোগ এনে রাজীব নামে এক যুবক থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এরপর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এই মামলায় গত ২৬ মার্চ থেকে পলাশ পঞ্চগড় জেলা কারাগারে ছিলেন। গত ২৬ এপ্রিল সকালে কারা হাসপাতালের একটি বাথরুম থেকে আগুনে দগ্ধ অবস্থায় চিৎকার করতে করতে বের হন পলাশ। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তাকে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩০ এপ্রিল মারা যান পলাশ।
পলাশের মা মিরা রানী বলেন, ‘কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানি পলাশের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছিল। সেই মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে একটা মানববন্ধন করি আমরা। মানববন্ধনে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করা হয়েছে বলে রাজীব রানা নামে একজন পলাশের নামে মামলা করে। এই মামলায় আমাকে এবং আমার ছেলেকে পুলিশ নিয়ে যায়। আমাকে রাতে ছাড়লেও পুলিশ পলাশকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠায়। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ২৬ মার্চ থেকে সে পঞ্চগড় জেলা কারাগারেই ছিল। আমি প্রায়ই আমার ছেলেকে কারাগারে দেখতে যেতাম।’
তিনি বলেন, ‘পলাশের গায়ে আগুনের বিষয়ে জেলার আমাকে কিছুই জানাননি। আমি দেখা করতে এসে শুনেছি ছেলের গায়ে আগুন দেওয়া হয়েছে। অথচ আমার নম্বর জেলারের কাছে ছিল।’
মিরা রানী জানান, দুজন ব্যক্তি আগুন দিয়েছে বলে পলাশ কুমার রায় তাকে বলেছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি রংপুর হাসপাতালে বসে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কীভাবে তোমার গায়ে আগুন লাগলো। ছেলে আমার দু… দু… দুজন ব্যক্তি, এভাবে বলেছে।’
আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত পলাশের মা মিরা রানী। পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তিনি ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই।’
পঞ্চগড় জেলা কারাগারের জেলারের বক্তব্য
কারাগারে পলাশ কুমার রায় নিজেই নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলে দাবি করেছেন পঞ্চগড় জেলা কারাগারের জেলার মুশফিকুর রহীম। তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি অফিসেই ছিলাম। চিৎকার শুনে আমি কারাগারের ভেতরে দৌড়ে যাই। দেখি, সবাই কারাগারের ভেতরে হাসপাতালের দিকে দৌড়াচ্ছে। আমিও সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি কারারক্ষী ও বন্দিদের জটলা। পলাশ কুমার রায় দগ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য থানা পুলিশ, সিভিল সার্জনকে ফোন দিলাম। কাগজপত্র ঠিক করে তাকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হয়।’
অডিও রেকর্ডের বিষয়ে জেলার বলেন, ‘এটা আমার কাছে কারসাজি মনে হয়। বানানো হতে পারে। তবে আমি এই বিষয় নিয়ে বেশি কথা বলবো না। কারণ ঘটনা জেলা প্রশাসন, কারা অধিদফতর তদন্ত করছে। তদন্তেই আসল ঘটনা বের হয়ে আসবে।’
রিটকারী আইনজীবীর বক্তব্য
আইনজীবী পলাশ কুমার রায়ের মৃত্যুর ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তিনি বলেন, ‘আমি রিট করেছি, বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়েছি। আমরা আদালতে রেকর্ডটিও দিয়েছি। রেকর্ডেই স্পষ্ট, পলাশ কী বলে গেছেন। তাই আমরাও মনে করি এটা হত্যাকাণ্ড।’
কোহিনূর কেমিক্যালের বক্তব্য
এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য কোহিনূর কেমিক্যালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ব্র্যান্ড) গোলাম কিবরিয়া সরকার ফোন রিসিভ করে প্রশ্ন শুনে নামাজে আছি বলে ফোন কেটে দেন। পরে তিনি আর কথা বলতে রাজি হননি।
পুলিশের বক্তব্য
পঞ্চগড় সদর থানার ওসি আবু আক্কাস আহম্মেদ বলেন, ‘এই ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষ ও পলাশের পরিবার কেউ কোনও অভিযোগ করেননি। আমাদের কাছে ২৬ তারিখে কেবল জানানো হয়েছিল, তিনি অসুস্থ, তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হবে। এরপর আর কিছু জানানো হয়নি।’