“মা” যিনি তার ছোট শিশু সন্তানকে পিঠে বেঁধে যুদ্ধ করেন : ঝাঁসির রাণী

মাত্র ১৪০০ জনের সৈন্য বাহিনী নিয়ে কয়েক হাজার ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর সাথে বীরবিক্রমে লড়াই করেছেন তিনি। যদিও ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বার্ষিক ৬০,০০০ টাকা বিধবা ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু তিনি যে আর সাধারন পাঁচটা মেয়ের মত না সেটা তিনি প্রমান করে দিয়েছিলেন সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়ে। আজ আমি আপনাদের জানাতে চলেছি ভারতের প্রথম মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামী মণিকর্ণিকা বা ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী বাঈ এর অনুপ্রেরনা মুলক জীবনী সম্পর্কে যার সাহসিকতার পরিচয় ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।

” alt=”” aria-hidden=”true” />

এই ঘটনার সূত্রপাত হয় ১৮২৮ সালের ১৯ শে নভেম্বর যখন ভারতের বারানসী (অধুনা মহারাষ্ট্রের অন্তর্গত) কাশী অঞ্চলে তিনি জন্মগ্রহন করেন। জন্মের সময় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল মনিকর্ণিকা। যদিও তাঁকে ডাকা হত মনু বলে। তাঁর পিতার নাম ছিল মরুপান্ত তাম্বে যিনি পেশোয়ার আদালতে কাজ করতেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল ভাগীরথী বাঈ।

মাত্র ৪ বছর বয়সেই মনিকর্ণিকা মাতৃহারা হয়েছিলেন। তাঁর পিতা আদালতের কাজে ব্যাস্ত থাকতেন বলে ছেলেবেলায় তিনি অন্যান্য মেয়েদের তুলনায় অনেক বেশী স্বাধীনতা ভোগ করতে পেরেছিলেন। ছেলে বেলায় বন্ধুদের সাথে খেলার ছলে শিকার করা, তলোয়ার চালানো, ঘোড়া চালানোর মত কৌশলগুলো তাঁর শেখা হয়ে গিয়েছিল। প্রসঙ্গত সেই সমস্ত বন্ধুদের নিয়ে নিজস্ব একটা বাহিনীও গড়ে তুলে ছিলেন যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নানা সাহেব, তাতিয়া টোপীর মত মানুষজন।

মাত্র ১৪ বছর বয়সে ১৮৪২ সালে ঝাঁসির মহারাজা রাজা গঙ্গাধর নেওয়ালকর এর সাথে মনিকর্ণিকা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং বিয়ের পর থেকেই মনিকর্ণিকা তাঁর নতুন নাম রানী লক্ষ্মীবাঈ নামে সকলের কাছে পরিচিত হলেন। প্রসঙ্গত জানা যায় হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর নামানুসারে এই নাম করন করা হয়েছিল।

১৮৫১ সালে ২৩ বছর বয়সে লক্ষ্মীবাঈ একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন, যার নাম রাখা হয় দামোদর রাও। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জন্মের মাত্র ৪ মাস পরেই শিশুটি মারা যায়। পুত্রশোক ভুলতে রাজা এবং রানী উভয়েই পরবর্তী সময় আনন্দ রাও নামে একটি শিশুকে দত্তক নেন। দত্তক নেওয়ার পর আনন্দ রাও এর নতুন নাম করন করে দামোদর রাও রাখা হয়।

তৎকালীন সময় ব্রিটিশ সরকার ভারতে “স্বত্ত বিলোপ” নীতির প্রয়োগ জারি করেছিল। অর্থাৎ যদি কোন রাজ বংশের উত্তরাধিকারী না থাকে তবে সেই রাজ্য কে ব্রিটিশ সরকারের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। রাজা গোপাল রাও চেয়েছিলেন তাঁর দত্তক পুত্র দামোদর রাও কে তাঁর মৃত্যুর পর পরবর্তী সময়ে সিংহাসনে বসাতে। তাই ব্রিটিশ সরকারের রাজনৈতিক কর্মচারীদের তত্বাবধানে আনন্দ রাও ওরফে দামোদর রাও কে পুত্র হিসেবে গ্রহন করার অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করেছিলেন। পাশাপাশি ব্রিটিশ সরকারকে লিখিত ভাবে জানিয়েছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দামোদর রাও সম্পূর্ণ সন্মানের সাথে রাজা হওয়ার অধিকারী এবং তাঁর বিধবা স্ত্রী লক্ষ্মী বাঈ সমস্ত জীবনের জন্য তাঁর রানী হিসেবে যতটা সন্মান পেয়েছেন তা বজায় রাখা বাধ্যতামূলক। এই ঘটনার কিছু দিন পর ১৮৫৩ সালের ২১ নভেম্বর রাজা গঙ্গাধর রাও মারা যান এবং তাঁর মৃত্যুর পরেই ব্রিটিশ সরকারের আসল চরিত্রটি বাইরে বেরিয়ে আসে। তারা রাজা গঙ্গাধর রাও এর পুত্র দামোদর রাও কে রাজা হিসেবে স্বীকার করতে অস্বীকার করে এবং গঙ্গাধর রাও এর চিঠিটি খারিজ করে দেয় এবং ঝাঁসির সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী নেই কারন দেখিয়ে ঝাঁসি কে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্তর্গত করার চেষ্টা শুরু করে। ফল হিসেবে ১৮৫৪ সালের মার্চ মাসে রানী লক্ষ্মী বাঈ কে বার্ষিক ৬০,০০০ টাকা ভাতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সকলকে ঝাঁসির কেল্লা পরিত্যাগ করার হুকুম জারি করে।

বাধ্য হয়ে রানী লক্ষ্মী বাঈ ঝাঁসির কেল্লা পরিত্যাগ করে ঝাঁসির রানী মহল এ থাকতে শুরু করেন। কিন্তু কিছুদিন থাকার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন ঝাঁসিকে কোন মতেই ব্রিটিশ সরকারের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। রানী মহল থেকেই রানী লক্ষ্মী বাঈ ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নীতি তৈরি করতে শুরু করেন। পাশাপাশি একটি সেনা বাহিনীও তৈরি করেছিলেন যেখানে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সকল কে লড়াই করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তাঁর এই ১৪০০ জনের সৈন্য বাহিনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন গুলাম খান, দোস্ত খান, খুদা বাকশ, কাশী বাঈ, মতি বাঈ, লালা ভাউ বক্সি, দেওয়ান রঘুনাথ সিং প্রমুখরা।

প্রায় এক বছর পর ব্রিটিশ সরকার ঝাঁসি তে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী বাঈ তাঁর ১৪০০ জনের সৈন্য বাহিনী নিয়ে সেই যুদ্ধতে সামিল হয়ে যান। ব্রিটিশদের কয়েক হাজার সেনার বিরুদ্ধে ঝাঁসির মাত্র ১৪০০ সেনা সাংঘাতিক সাহসিকতার সাথে প্রায় ২ সপ্তাহ ধরে লড়াই করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিশাল সৈন্য বাহিনীর কাছে হার মানতে বাধ্য হন তারা। তাই সময় বুঝে রানী লক্ষ্মী বাঈ তাঁর পুত্র দামোদর রাও এবং বাকি জীবিত অল্প সংখ্যক সৈন্যদের সাথে নিয়ে সেখান থেকে সরে গিয়ে তাঁর ছোট বেলার বন্ধু তাতিয়া টোপীর সাথে কালপি নামে এক জায়গায় আশ্রয় গ্রহন করেন।

বন্ধু তাতিয়া টোপী এবং শেষ সৈন্য বাহিনীর সাহায্যে তিনি গোয়ালিওরের কেল্লা আক্রমন করে দখল করে নেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন পর ব্রিটিশরা গোয়ালিওরের কেল্লা দখল করার উদ্দেশ্যেও যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। ফলে ফের রানী লক্ষ্মী বাঈ তাঁর অল্প সংখ্যক সৈন্য বাহিনী সাথে নিয়ে ব্রিটিশদের বিশাল সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়েন।

” alt=”” aria-hidden=”true” />

এই যুদ্ধে রানীর রুপ ছিল দেখার মত। দুই হাতে ধারালো তলোয়ার এবং নিজের পিঠে পুত্র দামোদর রাও কে বেঁধে নিয়ে তিনি ব্রিটিশ সৈনিক দের একের পর এক আঘাত করে চলেছিলেন। এই ভাবে বেশ কিছুদিন লড়াই করার পর ১৮৫৮ সালের ১৭ জুন তিনি ব্রিটিশ সেনাদের সাথে লড়াই করতে করতে গভীর ভাবে আহত হয়ে যান এবং মাত্র ২৯ বছর বয়সে এই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন।

তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দামোদর রাও তাঁর সৈন্য বাহিনীর সাথে থেকেই বড় হতে থাকেন যিনি ১৮ই মে ১৯০৬ সালে মারা যান। মাত্র ২৯ বছর বয়সে রানী লক্ষ্মী বাঈ বিশাল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যে সাহস দেখিয়েছেন তাঁর জন্য তিনি আজও আমাদের মাঝে অমর হয়ে আছেন। স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা ভারতের প্রথম মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামী মণিকর্ণিকা বা রানী লক্ষ্মী বাঈ এর গল্পটি ভালো লাগলে শেয়ার করে সবাই কে জানার সুযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ জানাই।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *