Lord Krishna House এর পক্ষ থেকে সবাইকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী উপলক্ষে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন ডাঃ কথক দাশ । ভগবানের জন্মাষ্টমীর মাধ্যমে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মঙ্গল কামনা করেছেন তিনি।
জন্মাষ্টমী ও শ্রীকৃষ্ণের ভগবত্তা
জন্মাষ্টমী, এইদিনেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হয়েছিলেন । বসুদেব যখন ছোট শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে বৃন্দাবন যাচ্ছিলেন তখন কারাগার আপনি আপনিই খুলে গেল । প্রহরী সহ সমস্ত জীব সেই রাতে ছিল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । যমুনা বসুদেবকে যাবার পথ করে দিল । কিন্তু অনেকেই বলে এসব সম্ভব হল কিভাবে ? প্রকৃতপক্ষে এই সব কিছুই কৃষ্ণের ভগবত্তা । উদাহরণস্বরূপ, একটি Dog (কুকুর) লিফটের অটোমেটিক দরজার সামনে দাঁড়ালে যদি সেটি খুলে যেতে পারে তবে God (ভগবান)’র জন্য কারাগারের দরজা কেন খুলবে না ? ঠিক একইভাবে শ্রীকৃষ্ণের কংস নিধন লীলাও তার ভগবত্তা । নিম্নে কৃষ্ণই যে একমাত্র পরমেশ্বর ভগবান তাঁর প্রমাণ তাঁর অদ্ভূত লীলার আলোকে প্রমাণ করা হল । লিখেছেন – আদিপুরুষ দাস
পরমহংস শিরোমণি শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে (২/৮৮) বলেছেন –
যাঁর ভগবত্তা হৈতে অন্যের ভগবত্তা ।
‘স্বয়ং ভগবান’- শব্দের তাহাতেই সত্তা ।।
অর্থাৎ “যাঁর ভগবত্তা থেকে অন্যের ভগবত্তা প্রকাশ পায়, তাঁকেই ‘স্বয়ং ভগবান’ বলা যায় । তাঁর মধ্যেই সেই সত্তা বিরাজমান ।”
এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্ । “ভগবানের সমস্ত অবতারেরা হচ্ছেন পুরুষাবতারদের অংশ অথবা কলা । কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান ।”
এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান্ স্বয়ম ।
উক্ত দুটি শ্লোকে ব্যবহৃত ‘ভগবান্’ বলতে কি বুঝায় তা এখন আলোচ্য ।
‘ভগ’ শব্দের অর্থ ঐশ্বর্য বা শক্তি ।
ঐশ্বর্যস্য সমগ্রস্য বীর্যস্য যশসঃ শ্রিয়ঃ ।
জ্ঞানবৈরাগ্যয়োশ্চৈব ষন্নং ভগ ইতীঙ্গনা ।। (বিষ্ণু পুরাণ ৬/৫/৭৪)
অর্থাৎ “সমগ্র ঐশ্বর্য্য, সমগ্র বীর্য, সমগ্র যশ, সমগ্র শ্রী (সৌন্দর্য ও সম্পত্তি) সমগ্র জ্ঞান, এবং সমগ্র বৈরাগ্য এই ছয়টি মহাশক্তির নাম ‘ভগ’ । সুতরাং এই সকল মহাশক্তি যাতে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে বর্তমান তিনিই ভগবান ।”
এই শ্লোক দ্বারা প্রমাণিত হয় যে ঐশ্বর্যাদি ষড়বিধ মহাশক্তিসম্পন্ন সচ্চিদানন্দ বিগ্রহই ভগবান ।
এই ঐশ্বর্যাদি বলতে কি বুঝায় তা সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক্ –
১) ঐশ্বর্য ঃ- ঐশ্বর্য অর্থে সর্ববশীকারিতা – যে শক্তিতে কেবল ঈশ্বরের ভাব প্রকাশিত হয় । ঈশ্বর বলতে ‘কর্তুমকর্তুং অন্যথা কর্তুং সমর্থঃ ।’ সুতরাং যে শক্তি সকলকে বশীভূত করতে পারে তারই নাম ঐশ্বর্য ।
শ্রীভগবানের কূর্ম, বরাহ, রাম, নৃসিংহাদি স্বাংশ স্বরূপের মধ্যে ঐশ্বর্যের প্রকাশ থাকলেও তাঁর পরিপূর্ণস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহে পূর্ণ মাধুর্যের প্রকাশ । তাঁর লীলায় এই মাধুর্য প্রকাশের আধিক্য থাকার জন্যই ভক্তরা তাঁর সম্বন্ধে ঐশ্বর্যজ্ঞানহীন শুদ্ধভক্তি দ্বারা তাতে প্রাণ মন ঢেলে সেবায় আত্মনিয়োগ করেন । সেজন্য্ যে লীলা তিনি নরলীলাভাবে প্রকাশ করেছেন এবং এই মনুষ্যভাবের যে লীলাতে মধুরভাবে প্রকাশ হয় সেটিই তাঁর মাধুর্য লীলা । আর এই ‘মাধুর্য ভগবত্তা সার’ ।
শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র পুরুষ, যিনি শাশ্বত কাল ধরে, সম্পূর্ণভাবে সমস্ত ঐশ্বর্যের অধিকারী । শ্রীকৃষ্ণই পূর্ণ ঐশ্বর্যসম্পন্ন পরমপুরুষ, পরমেশ্বর ভগবান । পূর্ণমাত্রায় ঐশ্বর্য সমূহের অধিকারী হওয়ার শ্রীকৃষ্ণ পরম আকর্ষক, তিনি সর্বাকর্ষক পরম পুরুষ, সেজন্যই তাঁর নাম ‘কৃষ্ণ’, যিনি সকলকে আকর্ষক-পূর্বক আনন্দ প্রদান করেন ।
২) বীর্য (পরম শক্তিমান) ঃ- বীর্য অর্থে শ্রীভগবানের অচিন্ত্য মহাশক্তি প্রকাশক পরাক্রম বুঝায় । এই পরাক্রম তাঁর মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, রাম, নৃসিংহাদি অবতারে প্রকৃষ্টরূপে প্রকাশিত হয়েছে । শ্রীরামচন্দ্র অবতারে তাঁর তাড়কাবধ, হরধনু ভঙ্গ, লঙ্কাবিজয় প্রভৃতিতে সম্পূর্ণ বীর্য অর্থাৎ পরাক্রমের প্রকাশ । পরিপূর্ণ স্বরূপ কৃষ্ণ অবতারেও দাবাগ্নি ভক্ষণ, কংস রঙ্গালয় এবং অবশেষে তার দন্তোৎপাটন করে তা দ্বারা হস্তীপালকসহ হস্তীকে সংহার । প্রবল পরাক্রান্ত জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত করে রুক্ষ্মিণীকে রথে আরোহণ করিয়ে তাঁর পাণিগ্রহন-সবই শ্রীকৃষ্ণের অমিত পরাক্রমের পরিচয় । শ্রীকৃষ্ণের অন্যান্য লীলায়ও তাঁর অত্যদ্ভূত ঐশ্বর্য ও বীর্যের প্রকাশ থাকলেও অধিকাংশ স্থলে তা মাধুর্যমন্ডিত-তাঁর নরলীলার অতিক্রম করেনি ।
শ্রীভগবানের কৃষ্ণলীলায় যেমন পূতনা রাক্ষসী বধের বৃত্তান্ত পাওয়া যায়, তেমনই তাঁর রামলীলাতেও তাড়কা রাক্ষসীর বধের বৃত্তান্ত আছে । কিন্তু পূতনাবধে যে অচিন্ত্য মহাশক্তির পরিচয় পাওয়া যায় অন্যলীলায় সেরকম নয় । দুই বৃত্তান্তেই রাক্ষসীবধ-কিন্তু রামলীলায় শ্রীরামচন্দ্র বিশ্বামিত্রের নিকট অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেছিলেন এবং সেই ব্রজতেজসম্পন্ন অস্ত্রদ্বারা তাড়কাকে নিহিত করেছিলেন । কৃষ্ণলীলায় পূতনাবধকালে কোনো অস্ত্রশিক্ষার প্রয়োজন হয়নি; তিনি ৬ দিন মাত্র বয়সে শৈশব অবস্থায় স্তন চুষতে চুষতেই ৬ ক্রোশ অর্থাৎ ১৮ কিলোমিটার (১ ক্রোশ = ৩ কিলোমিটার) বিরাট দেহধারী পূতনাকে বধ করেছিলেন ।
কৃষ্ণলীলায় যেমন গোবর্ধন ধারণ বৃত্তান্ত দেখা যায় তেমনই তাঁর কূর্মলীলায় কূর্ম-মূর্তিতে মন্দর পর্বতকে পৃষ্ঠে ধারণ করেছিলেন । কিন্তু কূর্মলীলায় সেই মন্দর পর্বতকে ধারণ করার জন্য তাঁর পৃষ্ঠদেশকে এক লক্ষ যোজন অর্থাৎ ১২ লক্ষ কিলোমিটার বিস্তৃত করতে হয়েছিল । পক্ষান্তরে, কৃষ্ণলীলায় যখন তিনি মাত্র সাত বছর বয়স্ক বালক তখন তাঁর বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল দ্বারা ক্রমাগত ৭ দিন পর্যন্ত বিশাল গোবর্ধন পর্বতকে ধারণ করে দন্ডায়মান ছিলেন ।
রাসলীলা আরম্ভে শ্রীকৃষ্ণ বংশীধ্বনি করলেন । ঐ ধ্বনি ৮৪ ক্রোশ মানে ৫২ কিলোমিটার ব্যাপি ব্রজমন্ডলে ব্যাপ্ত হল । যেখানে যত প্রেমবতী ব্রজাঙ্গনা ছিলেন তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের মধুর বংশীধ্বনিতে আকৃষ্ট হয়ে ছুটে এলেন । ‘জগৌ কলং বামদৃশাং মনোহরম’ (ভাগবত ১০/২৯/৩) অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ সুলোচনা ব্রজাঙ্গনাদের মনোহারী মধুর বেণুসঙ্গীত আরম্ভ করলেন । সুতরাং বুঝা যায় একমাত্র প্রেমবতী গোপাঙ্গনারাই কেবল সেই মধুর ধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন । সেটি শ্রীকৃষ্ণের অচিন্ত্য মাধুর্য, ঐশ্বর্য ও বীর্যশক্তির পরিচয় ।
কৃষ্ণ যখন মাতা যশোদাকে তার মুখের ভিতর অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ড বা বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু অনেকে বলে কিভাবে সম্ভব । অনন্তকোটি বিশ্বব্রহ্মান্ড ছোট্ট শিশুর মুখে !! প্রকৃতপক্ষে এইসব কৃষ্ণের ভগবত্তা
। উদাহরণ স্বরূপঃ একটি ছোট্ট মোবাইল স্ক্রীনে যদি ইন্টারনেট, টিভি, সিনেমা, গান মোটকথা পুরো বিশ্বের সব কিছুই দেখা যাই তাহলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখে কেন নই । কৃষ্ণই যে একমাত্র পরমেশ্বর ভগবান তাঁর প্রমাণ তাঁর অদ্ভূত লীলার আলোকে প্রমাণ করা যায় । আজকে কৃষ্ণের যশ ও শ্রী এর আলোচনা করা হবে –
যশ ঃ- শ্রীভগবানের যশ, তাঁর সদগুণ, খ্যাতি, ভক্তবাৎসল্য, প্রেমাধীনতা প্রভৃতি বিভিন্ন পুরাণে বর্ণিত রয়েছে । কৃষ্ণলীলায় এই যশ আরও মাধুর্যমন্ডিতভাবে প্রকাশিত । রাম নৃসিংহাদি লীলায় তিনি অসুর বিনাশ করেছিলেন । কিন্তু কাউকেও মুক্তি প্রদান করেননি । একমাত্র কৃষ্ণলীলায় তিনি তাঁর হস্তে নিহিত অসুরদেরকে মুক্তি প্রদান করে ‘হতারিগতি দায়কত্ব’ যশ লাভ করেছিলেন ।
বিষ্ণুপুরাণে বর্ণিত আছে বৈকুন্ঠপার্ষদ জয় বিজয় সনক সনাতনাদির অভিশাপে অসুর দেহ লাভ করে যথাক্রমে হিরণ্যকশিপু ও হিরণ্যাক্ষ, রাবণ ও কুম্ভকর্ণ এবং অবশেষে শিশুপাল ও দন্তবক্র রূপে জন্মগ্রহণ করেন । হিরণ্যকশিপু নৃসিংহদেবের হস্তে নিহিত হবার সময় নৃসিংহদেবকে ভগবান বলে ধারণা করতে পারে নি অদ্ভূত জীব বলেই ধারণা করেছিল । রজোগুণাক্রান্ত চিত্তে নৃসিংহদেবের পরাক্রমমাত্র চিন্তা করতে করতে নিহিত হয়েছিল । তাই পরজন্মে রাবণ হয়ে জন্মগ্রহণ করে ত্রৈলোক্যের ঐশ্বর্য লাভ করতে পেরেছিল । নৃসিংহদেবের ভগবত্তা চিত্তের আবেশ না হওয়ায় সংসার মুক্তিও লাভ করতে পারেনি । রাবণরূপে জন্মগ্রহণ করেও কামাসক্ত ছিল এবং শ্রীরামচন্দ্রের পত্নী জানকীকে সাধরণ জীব মনে করে ভোগ করবার জন্য প্রয়াসী হয়েছিল । তাই শ্রীরামচন্দ্রের হাতে নিহিত হয়ও শিশুপাল রূপে চেদিরাজকুলে জন্মগ্রহণ করে অতুল ঐশ্বর্য ভোগেরই অধিকারী হল । কিন্তু এজন্মে শিশুপাল তার পূর্ব জন্মের সঞ্চিত দ্বেষবশতঃ নিরন্তর কৃষ্ণকে নিন্দা করত-শয়নে, স্বপনে, আহারে বিহারে নিন্দাচ্ছলে কৃষ্ণনাম করে শ্রীভগবানের সর্ববিধ নাম গ্রহণ করত । শুধু নামগ্রহণ নয় নিরন্তর শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি তার হৃদয়ে উদ্ভাসিত থাকত । নিরন্তর এই কৃষ্ণনামোচ্চারণ ও কৃষ্ণের রূপচিন্তায় তার সর্ববিধ দোষ স্খলিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণেই বিলীন হয়ে গিয়েছিল । এতেই বুঝা যায় যে, শ্রীভগবানের সর্ববিধ মূর্তিতেই তাঁর ঐশ্বর্য বীর্যাদি মহাশক্তি বর্তমান থাকলেও একমাত্র স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মূর্তিতে সেইসবের পূর্ণ বিকাশ এবং এই লীলায় শ্রীভগবান অসুরদেরকে চিরতরে সংসার বন্ধন হতে মুক্তিদান করে হতারিগতিদায়করূপ অতুলনীয় অংশের প্রকাশ করেছিলেন ।
শ্রী (রূপবত্তা) ঃ- শ্রী অর্থে সৌন্দর্য ও সম্পদ দুই’ই হতে পারে । সমগ্র শ্রী অর্থে সৌন্দর্য বুঝালে শ্রীকৃষ্ণের সৌন্দর্য যে সর্ববিস্ময়কারিণী তা ভাগবতে (৩/১১/১২) বর্ণিত আছে ।
যন্মর্ত্যলীলৌপয়িকং স্বযোগ-
মায়াবলং দর্শয়তা গৃহীতম্ ।
বিস্মাপনং স্বস্য চ সৌভগর্দ্ধেঃ
পরং পদং ভূষণভূষণাঙ্গম্ ।।
অর্থাৎ “ভগবান এই জগতে স্বীয় যোগামায়াবলে প্রকটিত হয়েছেন । সেই মূর্তি মর্ত্যলীলার উপযোগী; তা এতই মনোরম যে, তাতে কৃষ্ণের নিজেরও বিস্ময় হয়-তা সৌভাগ্যের পরাকাষ্ঠা এবং সমস্ত সুন্দরের সুন্দর অর্থাৎ সমস্ত লৌকিক দৃশ্যের মধ্যে পরম অলৌকিক ।”
শ্রীচৈতণ্য চরিতামৃতে শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বর্ণনা করেছেন-
সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য, মাধুর্য, বৈদগ্ধ্য-বিলাস ।
ব্রজেন্দ্রনন্দনে ইহা অধিক উল্লাস ।।
গোবিন্দের মাধুরী দেখি’ বাসুদেবের ক্ষোভ ।
সে মাধুরী আস্বাদিতে উপজয় লোভ ।।
মথুরায় যৈছে গন্ধর্বনৃত্য-দরশনে ।
পুনঃ দ্বারকাতে যৈছে চিত্র-বিলোকনে ।। (চৈতণ্য চরিতামৃত মধ্য লীলা ২০/১৭৮, ১৭৯, ১৮১)
অর্থাৎ “সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য, মাধুর্য, বৈদগ্ধবিলাস আদি গুণগুলি বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ থেকে ব্রজন্দনন্দন কৃষ্ণে অধিক উপাদেয় । গোবিন্দের মাধুর্য দেখে বাসুদেবের ক্ষোভ হয় এবং সেই মাধুরী আস্বাদন করার জন্য তাঁর লোভ হয় । মথুরায় গন্ধর্ব নৃত্য দর্শন করে এবং দ্বারকায় চিত্র দর্শন করে বাসুদেব গোবিন্দের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন ।”
আবার ‘শ্রী’ অর্থে যদি সম্পদ ধরা যায়, তাহলে তাতেও সর্বসম্পদ পরিপূর্ণভাবে শ্রীকৃষ্ণে বিকশিত । যেমন শ্রীব্রহ্মসংহিতায় (৫/৫৬) বলা হয়ছে-
শ্রিয়ঃ কান্তাঃ কান্তঃ পরমপুরুষঃ কল্পতরবো
দ্রুমা ভূমিশ্চিন্তামমণি-গণময়ী তোয়মমৃতম্ ।
কথা গানং নাট্যং গমনমপি বংশী প্রিয়সখী
চিদানন্দং জ্যোতিঃ পরমপি তদাস্বাদ্যমপি চ ।।
অর্থাৎ ব্রহ্মা নিজ ইষ্টদেব শ্রীগোবিন্দের নিজধাম বৃন্দাবনের সম্পদ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন – এই বৃন্দাবন ধামের কৃষ্ণকান্তাগণ সকলেই লক্ষী এবং কান্ত পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ, বৃক্ষসকল কল্পতরু, ভূমি চিন্তামণি, জল অমৃত, স্বাভাবিক কথাই গান, সহজ গমনে নৃত্য, শ্রীকৃষ্ণের বংশীই প্রিয়সখী, চিদানন্দই পরমজ্যোতিঃস্বরূপ চন্দ্র সূর্য এবং সেই চিদানন্দ বস্তুও আস্বাদ্য ।
বৃন্দাবনের কৃষ্ণকান্তাগণ (গোপীগণ) স্বয়ং লহ্মী অপেক্ষা অনেক গুণবতী । (শ্রীরাধিকা লহ্মীগণের অংশনী, গোপীগণ তাঁর কায়ব্যূহ) । বৃন্দাবনের বৃক্ষসকল সাধারন বৃক্ষের মতো নয় -কল্পবৃক্ষের মতো যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায় । বৃন্দাবনের ভূমি সাধারণ মাটি নয়-তা চিন্তামণিময় । চিন্তামণির নিকট যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায় । বৃন্দাবনের জল অমৃতের মত স্বাদবিশিষ্ট । বৃন্দাবনবাসীদের স্বাভাবিক কথাবার্তা গীতের মতো মধুর । তাঁদের স্বাভাবিক চলাফেরাই নৃত্যের মত সুন্দর । শ্রীবৃন্দাবনে চিদানন্দ জ্যোতিই চন্দ্র সূর্য রূপে মূর্তিমান হয়ে আস্বাদ্য হন । প্রাকৃত চন্দ্র সূর্য জড়বস্তু-সকল সময়ে আনন্দদায়ক নয়, চন্দ্র অপূর্ণ কলা-অবস্থায় আনন্দদায়ক নয় । মধ্যাহ্নকালীন সূর্য খরতাবশতঃ জ্বালাকর, কিন্তু শ্রীবৃন্দাবনের চন্দ্র সূর্য জড়বস্তু নয়-চিন্ময়, সর্বদাই আনন্দপ্রদ । জ্ঞান :- জ্ঞানশক্তি বলে শ্রীভগবান সর্বজ্ঞ, স্বপ্রকাশ । জ্ঞান অর্থে জীবের ক্ষে কোনো বস্তু বিশেষ সম্বন্ধে চিত্তের ভাব । জীবের পক্ষে কোনো বস্তুকে দেখতে হলে, শুনতে হলে আঘ্রাণ করতে হলে, আস্বাদন করতে হলে, বা স্পর্শ করতে হলে যথাক্রমে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক-এই সব ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে নিতে হয়, কিন্তু শ্রীভগবানের পক্ষে তাঁর স্বরূপভূত জ্ঞান কোনো বস্তু বিশেষকে অপেক্ষা করে না । সেইজন্য তাঁকে অতীত বা ভবিষ্যতের সর্ববিষয়ে জ্ঞানবান বলা হয়-‘সঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিৎ’ (শ্রুতি)
গীতার ৭ম অধ্যায়ের ২৬নং শ্লোকে ভগবান নিজমুখে বলেছেন- বেদাহং সমতীতানি বর্তমানানি চার্জুন ।
ভবিষ্যানি চ ভূতানি মাং তু বেদ ন কশ্চন ।।
শ্রীকৃষ্ণের সর্বজ্ঞতার কথা চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাই, যখন তিনি মাত্র ৬ দিনের শিশু এবং মা যশোদার স্তন্যপান করেছেন সেই সময় পূতনা রাক্ষসী বাৎসল্যময়ী মাতৃমূর্তিবেশে উপস্থিত হলে চরাচরের অন্তর্যামীর নিকট পূতনারাক্ষসীর আগমনের উদ্দেশ্য অজানা ছিল না । তাই তাকে দেখে তার মুখ দর্শনে অনিচ্ছুক হয়ে চক্ষু বন্ধ করে রেখেছিলেন । “বিবুধ্য তাং বাক-মারিকাগ্রহং চরাচরাত্মা স নিমীলিতেক্ষণঃ ।” আবার ব্রহ্মমোহন লীলায় দেখতে পাই ব্রহ্মা যখন শ্রীকৃষ্ণের ভগবত্তা পরীক্ষা করার জন্য গোবৎস ও গোপবালকদেরকে মায়ামুগ্ধ করে বহুদূরে স্থানান্তরিত করে রেখেছিলেন তখন পর্যন্ত সর্বজ্ঞ কৃষ্ণ মুগ্ধ বালকের মতো বনভূমির সর্বত্র সখাদের ও গোবৎসদেরকে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন । অবশেষে তাঁর সর্বজ্ঞতাশক্তির প্রভাবে জানতে পারলেন যে, ব্রহ্মাই ঐসকল সখা ও গোবৎসদেরকে স্থানান্তিরিত করেছেন । >বৈরাগ্যঃ – সাধারনত মায়িক বস্তুতে আসক্ত না হওয়াকেই বৈরাগ্য বলা হয় । জীবের পক্ষে এই বৈরাগ্য সাধনার দ্বারা লাভ করতে হয় । কিন্তু শ্রীভগবানের পক্ষে কোনো সাধনের আবশ্যকতা হয় না । বৈরাগ্য তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক । বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ গো-গোপ ও গোপিদের সঙ্গে কত না ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন, তবুও হঠাৎ তাঁদেরকে ত্যাগ করে মথুরায় চলে গেলেন । মথুরায় থাকাকালেও তিনি যুধিষ্ঠিরাদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য কাম্যবনে এসেছিলেন । বৃন্দাবন সেখান থেকে বেশী দূরে নয়, অথচ তিনি সেখানে একবারও গেলেন না । ঠিক তেমনিই দ্বারকা-লীলাতেও তিনি পুত্র-পৌত্রাদি আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কতনা ঘনিষ্ঠভাবে বসবাস করেছেন, কিন্তু হঠাৎ ব্রহ্মশাপ-ছলে যদুকুল ধ্বংশ করলেন । এ থেকে বোঝা যায় তিনি কতটা অনাশক্ত । অতএব এ পর্যন্ত শ্রীভগবানের ষড়বিধ ‘ভগ’ অর্থাৎ ঐশ্বর্যের কথা আলোচনা করে আমরা এই সিধান্তে উপনীত হতে পারি যে, কেবল কৃষ্ণই একমাত্র পরমেশ্বর ভগবান আর কেউ নন ।