বাঙালী হিন্দুর ঘরে বারো মাসে তেরো পার্বণ। নিত্য পূজো, ব্রত পূজো, মাসিক পূজো এবং বছরের পূজো। পূজো, ব্রতকথা নিয়েই ব্যস্ত
সময় কেটে যায় হিন্দু নারীদের।
প্রতিমাসেই লেগে আছে এই ব্রত,
সেই ব্রত। কিছু কিছু ব্রতপূজোর আবার
শ্রেণীভেদ আছে। উপাসনাও
বয়সভেদে নির্ণিত হয়ে থাকে।
যেমন একটি মেয়ের বিয়ের আগে
আরাধ্য দেবতা থাকেন শিবঠাকুর,
বিয়ের পর বাকী জীবন
আরাধ্যদেবতার আসনে থাকেন
লক্ষ্মীদেবী। একজন মা সন্তান
কামনার জন্য ষষ্ঠী ঠাইরেণের কৃপা
কামনা করেন এবং যুবক পুত্রের আয়-
উন্নতির জন্য ‘গনেশ ঠাকুরের’ কৃপা
কামনা করেন। প্রতিটি নারী
সংসারের মঙ্গলের জন্য
বিপদতারিণী দেবীর পূজা করেন।
নারী জীবনের প্রতিটি ধাপে
একটি করে ব্রতপূজা নির্ধারিত
আছে। কুমারী মেয়েদের কাছে
প্রিয়তার শীর্ষে আছেন শিবঠাকুর।
সব মেয়েই বিয়ের স্বপ্ন দেখে,
ছোটবেলা থেকেই তাদেরকে
শোনানো হয়, শিবঠাকুরের মত বর
পেলে নারীজীবন সার্থক হয়। এমন
কথা শোনানোর দায়িত্ব থাকে
সকল মাতৃস্থানীয়াদের উপর। ভাল
কাজের প্রশংসাসূচক আশীর্বাদ
বাণীটি হয়, “ বেঁচে থাকো কন্যা,
শিবের মত স্বামী হোক তোমার”।
শুধু আশীর্বাদ করেই কর্তব্য সমাপ্ত
হয়না, মেয়ের ভাগ্যে ‘শিব ঠাকুর’
জুটিয়ে দেয়ার জন্য, মায়েরা সেই
ছোটবেলা থেকেই মেয়েকে
দিয়ে ‘শিব পূজো’ করাতে থাকেন।
নিজে তো মহিষাসুরের সাথে
সংসার করতে করতে বীতশ্রদ্ধ, তাই
মেয়েজামাইটি যেন শিব ঠাকুর হয়,
সেই চিন্তায় অস্থির থাকেন।
মেয়েকে দিয়ে প্রতি সোমবার
শিবের মাথায় জল দেওয়ান, প্রতি
বছর শিবরাত্রীতে মেয়েকে নিরম্বু
উপবাস রেখে সন্ধ্যাবেলায়
শিবের মাথায় জল, বেলপাতা, ফুল
দেওয়ান, যাতে কন্যাটি শিব
ঠাকুরের মত স্বামী পায়।
কেন, শিব ঠাকুর কেন? কারণ, শিব
ঠাকুরের আরেক নাম ভোলানাথ,
জগৎ সংসার ভুলে থাকেন,
অন্দরমহলে উঁকিঝুঁকি মারেননা,
স্ত্রী-কন্যাদের উপর মাতব্বরী
করেননা, স্ত্রীকে অহর্নিশি
বকাঝকা করেননা, তেল-মসলা,
চাল-ডালের হিসেব নেন না,
ভাঙের শরবত খেয়ে বাবাঠাকুর
আপনমনে থাকেন। ফলে দেবী
পার্বতী নিজের খেয়ালখুশীমত
সংসার পরিচালনা করতে পারেন।
অবশ্য মাঝে মাঝে শিবঠাকুর উগ্র
চন্ডাল মূর্তি ধারণ করেন, তখন দেবী
পার্বতীও নিরীহ মূর্তি ছেড়ে
মহিষাসুর মর্দিনী রূপ ধারণ করেন,
রূপের অমন আগুনছটায় ভয় পেয়ে শিব
নিমিষেই আবার ব্যোম ভোলানাথ
হয়ে যান।
এইজন্যই মায়েরা কন্যাকে দিয়ে
শিবপূজো করান, আর শিবের মত
স্বামী পেয়ে আনন্দে আটখানা
হয়ে কন্যাগুলো শ্বশুরবাড়ীর পথে
পা বাড়ায়। মেয়েকে শ্বশুরবাড়ী
পাঠিয়ে মা কী নিশ্চিন্ত হতে
পারেন! পারেন না! মনে পড়ে যায়,
নিজের শিবঠাকুর প্রাপ্তির কথা।
কত সাধনা করে উনিও শিব ঠাকুর
স্বামী পেয়েছিলেন, কিন্তু
সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে
সাধনচর্চায় ছেদ পড়তেই শিব ঠাকুর
স্বামী কখন যেন মহিষাসুর হয়ে
গেলেন, উনি টেরই পেলেননা!
সারাজীবন শিবের স্তুতি
গেয়েছেন, দেবী পার্বতীর
আরাধনা তো করেননি, তাই
মহিষাসুরমর্দিনি হতে পারেননি।
এইজন্যই মেয়ের বেলায় আর কোন
ঝুঁকী নিতে রাজী নন।
জামাইবাবাজীকে বশে রাখতে
কত রকমের উপায় খুঁজেন। খুঁজে খুঁজে
পেয়ে যান ‘জামাইষষ্ঠী’ ব্রতপূজা্র
বিধান। বছরের একটি দিন,
জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি, যখন আম-
কাঁঠালের পাকা গন্ধে চারদিক
সুবাসিত, তখনই এই ব্রতটি উদযাপণ
করতে হয়। শ্বশুরবাড়ীতে ‘জামাই
আদরের’ ঘটা পড়ে যায়।
‘জামাইষষ্ঠী’ ব্রতপূজার যা কিছু, সবই
কন্যার শিবঠাকুর স্বামীটিকে
ঘিরে আবর্তিত হয়ে থাকে।
জামাই ষষ্ঠী এমনই এক ব্রত, যেখানে
শাশুড়ীমাতা কন্যা-জামাতার
দীর্ঘায়ু কামনা করেন, জামাতার
যশ কামনা করেন, জামাতার জন্য
অর্থ-বিত্ত কামনা করেন, কন্যা-
জামাতার কোল ভরে সুস্থ সন্তান
কামনা করেন, এমনই আরও কত ধরণের
মঙ্গলাকাংক্ষা করে থাকেন!
তবে শুকনো কথায়
‘মংগলাকাংক্ষা’ করলে কী
জামাই বাবাজীর পেট ভরবে?
মায়েরা অমন অবুঝও নন, উনারা
জামাইবাবাজীকে যথাযথ সম্মান
সহকারে, উপঢৌকন পাঠিয়ে
শ্বশুরবাড়ী আসার জন্য নিমন্ত্রণ
করেন। শাশুড়ীমায়ের নিমন্ত্রণ
রক্ষার্থে জামাই বাবাজী
শ্বশুড়বাড়ীতে পা দেয়ার সাথে
সাথে শুরু হয়ে যায় জামাই
অভ্যর্থণার সকল আচার-অনুষ্ঠান।
পথশ্রান্ত জামাতাকে বসবার জন্য
নানা রঙ-বেরঙের নক্সাখচিত
সবচেয়ে সুন্দর আসনখানি মাটিতে
বিছিয়ে দেন, হাতপাখা্র শীতল
বাতাসে বাবাজীর ঘামে ভেজা
শরীরটিকে ঠান্ডা করেন, যত্নে
তুলে রাখা শ্বেত পাথরের গেলাস
ভরে ডাবের ঠান্ডা জল পান করতে
দেন। এরপর ষষ্ঠীদেবীর
আশীর্বাদপূর্ণ দূর্বা-বাঁশের কড়ুল,
ধান, ফুল, করমচা দিয়ে বাঁধা ‘মুঠা’
জামাইবাবাজীর মাথায় ছুঁইয়ে
‘ষাট ষাট, বালাই ষাট’ করে
স্নেহাশীর্বাদ করেন। আশীর্বাদ
শেষে বিশাল বড় কাঁসার রেকাবী
নাড়ু, মোয়া, পিঠে, সন্দেশ, মিষ্টি,
ফল-মূলে সাজিয়ে খেতে দেন।
জামাইভোজের জন্য বিশাল
আয়োজন করা হয়। পুকুরে জাল ফেলে
সবচেয়ে বড় কাতলা মাছ তোলান,
মাছের আস্ত মুড়ো জামাই
বাবাজীর পাতে তুলে দেন। ষোড়শ
ব্যাঞ্জনে জামাইথালা সাজান,
বড় জামবাটিতে কালো গাইয়ের
ঘন ক্ষীরদুধ, গাছপাকা আম, কাঁঠাল,
কলা তো থাকেই। ভোজনশেষে
পান-সুপুরীর বাটা, শান্তিপুরী
ধুতি, ফিনফিনে পাতলা আদ্দির
কাপড়ে তৈরী পাঞ্জাবী, সাথে
মানানসই চিকন সূতোয় বোনা
দামী উত্তরীয়, কোলাপুরী চপ্পল
দিয়ে ডালি সাজিয়ে
শাশুড়ীমাতা জামাইবাবাজীকে
আশীর্বাদ করেন, নিজ কন্যাটিকে
সুখে রেখেছেন বলে ‘শিবঠাকুর’
বাবাজীকে আন্তরিক ধন্যবাদ
জানান এবং কন্যা-জামাতার
ভবিষ্যত জীবন আরও সুখের, আরও
শান্তির, আরও সমৃদ্ধির হোক, সেই
কামনা করেন।
** জামাইবাবাজী কিন্তু খালি
হাতে শ্বশুরবাড়ী আসেনা, যতই
আত্মভোলা হোক না কেন, শাশুড়ী
মায়ের জন্য শান্তিপুরী তাঁত বা
ঢাকাই জামদানী, ঝুড়ি ভর্তি আম,
কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, পান-সুপুরী,
নদীর ঘাট থেকে কানকো
নাড়ানো পাকা রুই বা কাতল মাছ,
ময়রার দোকান থেকে গরম
রসগোল্লার হাঁড়ি, ছানার সন্দেশ
ভর্তি বাক্স সাথে আনতে ভুলেনা।
শাশুড়ী মা যখন ‘শিব ঠাকুর’
জামাতাটিকে ধান-দূর্বা-উলু
দিয়ে আশীর্বাদ করেন, জামাই
বাবাজীও শাশুড়ীমায়ের চরণ স্পর্শ
করে, চরণধূলিটুকু আশীর্বাদ হিসেবে
মাথায় তুলে নেয়।
জামাই ষষ্ঠী সম্পর্কে ১০ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
১। জামাই ষষ্ঠী একেবারেই বাঙালি পার্বন। ওপার বাংলার সন্তান ষষ্ঠী এবার বাংলায় খুব বেশি করে জামাইদের খুশি করার পরব। তবে ধর্মীয় ভাবে এই দিনটি বেশি পালিত হয় অরণ্যষষ্ঠী হিসেবে। তবে মনে রাখতে হবে ষষ্ঠী দেবী শুধু বাঙালির পূজ্যা নন, তিনি সর্বভারতীয়।
২। মা ষষ্ঠী নিছক বাংলার এক গ্রামদেবী নন, মঙ্গলকাব্যের অপর দুই দেবী শীতলা ও মনসার মতোই তিনিও ভারতের নানা অঞ্চলে পূজিত হন।
৩। ষষ্ঠী ব্রতর কাহিনিটিও খুব বার্তাবহ। এক যৌথ পরিবারের ছোট বউ রোজ খাবার চুরি করে আর একটা কালো বেড়ালের নামে দোষ দেয়। বেড়ালটা এর প্রতিশোধ নিতে সেই ছোট বউয়ের বাচ্চা হলেই তাকে তুলে নিয়ে মা ষষ্ঠীর কাছে লুকিয়ে রেখে আসত। বউটি তা জানতে পেরে দেবীর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করল। মা ষষ্ঠী তাকে ক্ষমা করলেন দুই শর্তে। বললেন, এই দিন তাঁর পুজো করতে হবে এবং কালো বেড়ালকে তাঁর বাহন হিসেবে সম্মান করতে হবে।
৪। বায়ুপুরাণে ষষ্ঠী ৪৯টি দেবীর অন্যতম, আর একটি পুরাণে তাঁকে ‘সমস্ত মাতৃদেবীর মধ্যে আরাধ্যতমা’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
৫। যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতিতে মা ষষ্ঠী স্কন্দদেবের পালিকা-মা ও রক্ষয়িত্রী। পদ্মপুরাণেও তিনি স্কন্দের স্ত্রী।
৬। দেবী ষষ্ঠীর কাহিনিগুলি পাওয়া যায় বাংলায় মঙ্গলকাব্যে। ষষ্ঠীমঙ্গলে সর্পদেবীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে।
৭। অন্য রাজ্যেও ষষ্ঠী পূজার সঙ্গে সন্তান জন্মের সম্পর্ক রয়েছে। বিহারে সন্তানজন্মের পরে ছ’দিনের অনুষ্ঠানটিকে ছ’ঠী বলা হয়, ষষ্ঠী সেখানে ছ’ঠী মাতা, সন্তানহীনা দম্পতিরা তাঁর আরাধনায় ব্রত পালন করেন, ষষ্ঠী ব্রত। ওডিশায় সন্তানজন্মের ছ’দিন এবং একুশ দিনে এই দেবী পূজিত হন। উত্তর ভারতের কোথাও কোথাও বিয়ের সময়েও ষষ্ঠীর পুজো করা হয়। বাংলাতেও অনেকের মধ্যে ষষ্ঠী পালনের রেওয়াজ রয়েছে।
৮। ষষ্ঠী দেবীর মূর্তি পূজা হয় পূর্ববঙ্গে। মার্জারবাহিনী ষষ্ঠীর কোলে এক বা একাধিক শিশু। দুধ পুকুরের সামনে বট গাছের নীচে তাঁর অধিষ্ঠান।
৯। ষষ্ঠীকে আবার অমঙ্গলের দেবী বলা হয়েছে, তিনি কুপিত হলে মা ও শিশুদের দুঃখ দেন। কাশ্যপ সংহিতায় ষষ্ঠীকে বলা হয়েছে ‘জাতহরণী’, যিনি মাতৃগর্ভ থেকে ভ্রূণ অপহরণ করেন, সন্তান জন্মের ছ’দিনের মধ্যে তাকে ভক্ষণ করেন, তাই শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে ষষ্ঠ দিনে তাঁকে পুজো করা বিধেয়।
১০। এ-সবের মধ্যে জামাই ঢুকল কী করে? লোকাচার বিষয়ক গবেষকদের দাবি, আঠারো-উনিশ শতকে বাংলায় বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহের ব্যাপক প্রচলন ছিল। বালবিধবা সমস্যা তখন মারাত্মক। এই অবস্থায় জামাই ও স্বামীর দীর্ঘ জীবনের প্রার্থনা বাঙালি মা এবং মেয়ের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর তার থেকেই অরণ্য ষষ্ঠী হয়ে ওঠে জামাইকে আপ্যায়নের পরব।