জ্যোতিষ শাস্ত্রের পরিচয়
ছয়টি বেদাঙ্গের একটি জ্যোতিষ। প্রাচীনকালে জ্যোতিষ অনুসারে শুভ তিথি- যজ্ঞ করা হত। জ্যোতি অর্থ আলো। বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্র দীপ্তিমান অর্থাৎ এদের জ্যোতি বা আলো রয়েছে। মানব-জীবনে বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব সংক্রান্ত জ্ঞান বা বিদ্যাই জ্যোতিষ বিজ্ঞান। ভৃগু, পরাশর, জৈমিনি আদি প্রাচীন ঋষিগণকে জ্যোতিষ বিজ্ঞানের প্রবর্তক বলা চলে। তাঁরা জ্যোতিষবিদ্যা বিভিন্ন অঙ্গ বা শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি করে গেছেন। তাঁরা উপলব্ধি করেছেন যে, পৃথিবীর নিকটবর্তী নয়টি গ্রহ, বারটি রাশি ও সাতাশটি নক্ষত্র মানুষের জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং এই প্রভাবই জ্যোতিষ বিজ্ঞানের মুখ্য আলোচ্য বিষয়। জাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় এসব গ্রহ, রাশি ও নক্ষত্রের অবস্থান অনুসারে জাতকের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়। নিচে জ্যোতিষ বিজ্ঞানেরবিভিন্ন বিষয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া হল।
গ্রহ পরিচয়
জ্যোতিষ বিজ্ঞান বলে গ্রহগণ নিছক জড় বস্ত্ত নয়। জ্যোতিষ শান্ত্রে গ্রহগণকে দেবতা জ্ঞান করা করেছে। গ্রহগণ সর্বদা ঘুর্ণায়মান। প্রত্যেক মানুষ কোন না কোন গ্রহ দ্বারা প্রভাবিত। গ্রহগণ ঘুরতে ঘুরতে যখন শুভ অবস্থানে থাকে তখন জাতকের শুভ হয় এবং গ্রহগণ যখন অশুভ অবস্থানে থাকে তখন জাতকের অশুভ হয়। নবগ্রহের নাম- ১) রবি, ২) সোম, ৩) মঙ্গল, ৪) বুধ, ৫) বৃহস্পতি, ৬) শুক্র, ৭) শনি, ৮) রাহু ও ৯) কেতু। এই নবগ্রহের মধ্যে সোম, বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্র এই চারটি গ্রহ অধিকাংশ সময় শুভফল প্রদান করে বলে এদেরকে শুভ গ্রহ এবং রবি, মঙ্গল, শনি, রাহু ও কেতু এই পাঁচটি গ্রহ অধিকাংশ সময় অশুভফল প্রদান করে বলে এদেরকে অশুভ গ্রহ বা পাপ গ্রহ বলে। নবগ্রহের রবি, মঙ্গল ও বৃহস্পতি পুরুষ, চন্দ্র ও শুক্র স্ত্রী এবং বুধ ও শনি ক্লীব বা নপুংসক। রবি একটি রাশিতে ত্রিশ দিন, চন্দ্র সোয়া দুই দিন, মঙ্গল পয়তাল্লিশ দিন, বুধ আঠার দিন, বৃহস্পতি এক বছর, শুক্র আটাশ দিন, শনি আড়াই বছর এবং রাহু-কেতু দেড় বছর অবস্থান করে।
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে গ্রহদের কারকতা
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে রবি আত্মা, পিতা, রক্ত বর্ণ, কটু (ঝাল) রস, পিত্ত ধাতু, স্বভাব, যশ-খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির কারক। চন্দ্র মন, মাতা, জল, শুভ্রবর্ণ, লবণ রস, শ্লেষ্মা ধাতু, চঞ্চলতা, চিন্তাশক্তি, সাহিত্য প্রভৃতির কারক। মঙ্গল শক্তি, ভ্রাতৃ, ভূমি, সম্পত্তি, সাহস, পরাক্রম, অগ্নি, লাল বর্ণ, তিক্ত রস, পিত্ত ধাতু প্রভৃতির কারক। বুধ বুদ্ধি, মাতুল, বাণিজ্য, বাক্-শক্তি, মিশ্র রস, সম ধাতু, হাস্য, শিল্প, সাহিত্য, সবুজ বর্ণ প্রভৃতির কারক। বৃহস্পতি ধর্ম, পুত্র, ধন, জ্ঞান, মিষ্টি রস, কফ ধাতু, হলুদ বর্ণ প্রভৃতির কারক। শুক্র প্রেম, কাম, স্ত্রী, সুখ, অম্ল রস, কফ ধাতু, গীত, কাব্য, শুভ্র বর্ণ প্রভৃতির কারক। শনি দুঃখ, মৃত্যু, বিপদ, কষায় রস, বায়ু ধাতু, অস্ত্র, আধ্যাত্মিকতা, গুপ্তবিদ্যা প্রভৃতির কারক নীল বর্ণ প্রভৃতির কারক। রাহু শত্রু, নিদ্রা, চৌর্য, বিষক্রিয়া, পিতামহ, দ্যুত-ক্রিড়া, বায়ু ধাতু, কাল বর্ণ প্রভৃতির কারক। কেতু মাতামহ, সর্প, দংশন, ক্ষুধা, ধুম্র বর্ণ, ব্রণ ও চর্ম রোগ প্রভৃতির কারক।
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে গ্রহদের শত্রু-মিত্র ও গ্রহ-দৃষ্টি কথন
জ্যোতিষ বিজ্ঞান বলে গ্রহদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা-মিত্রতা রয়েছে।রবির মিত্র- চন্দ্র, মঙ্গল ও বৃহস্পতি, শত্রু- শুক্র ও শনি এবং সম- বুধ।চন্দ্রের মিত্র- রবি ও বুধ, শত্রু- নেই এবং সম- মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি। মঙ্গলের মিত্র- রবি, চন্দ্র ও বৃহস্পতি, শত্রু- বুধ এবং সম-শুক্র ও শনি। বুধের মিত্র- রবি ও শুক্র, শত্রু- চন্দ্র এবং সম- শনি,মঙ্গল ও বৃহস্পতি। বৃহস্পতির মিত্র- রবি, চন্দ্র ও মঙ্গল, শত্রু- বুধ ও শুক্র এবং সম- শনি। শুক্রের মিত্র- বুধ ও শনি, শত্রু- রবি ও চন্দ্র এবং সম- মঙ্গল ও বৃহস্পতি। শনির মিত্র- বুধ ও শুক্র, শত্রু- রবি, চন্দ্র ও মঙ্গল এবং সম– বৃহস্পতি। রাহুর মিত্র- শুক্র ও শনি, শত্রু- রবি, চন্দ্র ও মঙ্গল এবং সম- বুধ ও বৃহস্পতি। কেতুর মিত্র- রবি ও চন্দ্র,শত্রু- শুক্র ও শনি এবং সম- বুধ ও বৃহস্পতি।
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে গ্রহশুদ্ধি
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে বারটি নক্ষপুঞ্জ বা রাশি মহাকাশে বৃত্তাকারে অবস্থান করছে। একটি বৃত্তের মোট ৩৬০ অংশ ধরা হয়। তাহলে বারটি রাশির জন্য ৩৬০ অংশ থাকলে প্রত্যেকটি রাশির জন্য ৩৬০/১২ = ৩০ অংশ থাকে। বারটি রাশির জন্য ৩০ অংশ করে ১২টি স্থান রয়েছে। নয়টি গ্রহ তাদের নিজ নিজ গতিতে নির্দিষ্ট সময়ে একটি রাশির ৩০ অংশ স্থান অতিক্রম করে পরের রাশির স্থানে গমন করে এবং এভাবে পর্যায়ক্রমে বারটি রাশির স্থান ভ্রমণ করে। অংশেরও ক্ষুদ্র ভাগ আছে যথা- ৬০ বিকলায় ১ কলা, ৬০ কলায় ১ অংশ এবং ৩০ অংশে এক রাশি। গ্রহগণ ১২টি রাশির ১২টি স্থানেই শুভফল দেয় না। যেমন চন্দ্র ১ম, ৩য়, ৬ষ্ঠ, ৭ম, ১০ম ও ১১শ স্থানে থাকলে শুদ্ধ হয় এবং শুভ ফল প্রদান করে। যেমন কর্কট রাশির ক্ষেত্রে কর্কট (১ম), কন্যা (৩য়), ধনু (৬ষ্ঠ), মকর (৭ম), মেষ (১০ম) ও বৃষে (১১শ) চন্দ্র অবস্থানের সময় চন্দ্র-শুদ্ধি হয়। তবে শুক্লপক্ষে চন্দ্র ২য়, ৫ম ও ৯ম স্থানেও শুভ ফল প্রদান করে। রবি জন্মরাশি হতে ৩য়, ৬ষ্ঠ, ১০ম ও ১১শ স্থানে থাকলে শুদ্ধ হয়। চন্দ্রশুদ্ধি ও রবিশুদ্ধি থাকলে অন্যান্য গ্রহের অশুভ ফল হ্রাস পায়। শনি, মঙ্গল, রাহু ও কেতু প্রত্যেকে জন্ম রাশি হতে ৩য়, ৬ষ্ঠ, ১০ম ও ১১শ স্থানে থাকলে শুদ্ধ হয়। বৃহস্পতি জন্ম রাশি হতে ২য়, ৫ম, ৭ম, ৯ম ও ১১শ স্থানে থাকলে শুদ্ধ হয়। বুধ জন্ম রাশি হতে ২য়, ৪র্থ, ৬ষ্ঠ, ৮ম, ১০ম, ১১শ ও ১২শ স্থানে থাকলে শুদ্ধ হয়। একাদশ স্থান একটি বিশেষ স্থান যেখানে সব গ্রহই শুভ ফল প্রদান করে। মেষ রাশির প্রথমে, বৃষ রাশির পঞ্চমে, মিথুন রাশির নবমে, কর্কট রাশির দ্বিতীয়ে, সিংহ রাশির ষষ্ঠে, কন্যা রাশির দশমে, তুলা রাশির তৃতীয়ে, বৃশ্চিকরাশির সপ্তমে, ধনু রাশির চতুর্থে, মকর রাশির অষ্টমে, কুম্ভ রাশির একাদশে এবং মীন রাশির দ্বাদশে চন্দ্র অবস্থান করলে ঘাত-চন্দ্র হয়। ঘাত-চন্দ্রে যাত্রা ও বিবাহ অশুভ।
রাশি পরিচয়
পৃথিবীর চতুর্দিকে যে দ্বাদশ সংখ্যক নক্ষত্রপুঞ্জ বা নক্ষত্ররাশি রয়েছে তা সংক্ষেপে রাশি নামে পরিচিত। পৃথিবী থেকে যে নক্ষত্র-রাশিকে যেমন দেখা যায় ঐ নক্ষত্ররাশিকে তেমন নাম দেয়া হয়েছে। যেমন- পৃথিবী থেকে যে নক্ষত্ররাশিকে মেষ বা ভেড়ার মত মনে হয় সে নক্ষত্ররাশির নাম ‘মেষ’ রাখা হয়েছে। একইভাবে অন্যান্য রাশিগুলোরও নামকরণ করা হয়েছে। জ্যোতিষ শাস্ত্রে উল্লিখিত বারটি রাশির নাম- ১) মেষ, ২) বৃষ, ৩) মিথুন, ৪) কর্কট, ৫) সিংহ, ৬) কন্যা, ৭) তুলা, ৮) বৃশ্চিক, ৯) ধনু, ১০) মকর, ১১) কুম্ভ ক্রূর ও ১২) মীন। মেষ- ক্রূর, বিষম, চর (গতিশীল) ও হ্রস, বৃষ- সৌম্য, সম, স্থির ও হ্রস, মিথুন- ক্রূর, বিষম ও দ্ব্যাত্মক, কর্কট- সৌম্য, সম ও চর, সিংহ- ক্রূর, বিষম, স্থির ও দীর্ঘ, কন্যা- সৌম্য, সম, দ্ব্যাত্মক ও দীর্ঘ, তুলা- ক্রূর, বিষম, চর ও দীর্ঘ, বৃশ্চিক- সৌম্য, সম, স্থির ও দীর্ঘ, ধনু- ক্রূর, বিষম ও দ্ব্যাত্মক, মকর- সৌম্য, সম ও চর, কুম্ভ- ক্রূর, বিষম, স্থির ও হ্রস এবং মীন- সৌম্য, সম, দ্ব্যাত্মক ও হ্রস। বারটি রাশির মধ্যে মেষ, সিংহ ও ধনুকে অগ্নি রাশি, বৃষ, কন্যা ও মকরকে পৃথ্বী রাশি, মিথুন, তুলা ও কুম্ভকে বায়ু রাশি এবং কর্কট, বৃশ্চিক ও মীনকে জল রাশি বলে। মেষ রাশির নামের আদ্যার- অ এবং ল, বৃষ রাশির নামের আদ্যাক্ষর-ই, উ এবং ব, মিথুন রাশির নামের আদ্যাক্ষর- ক, ছ, ঘ এবং ঙ, কর্কট রাশির নামের আদ্যাক্ষর- ড এবং হ, সিংহ রাশির নামের আদ্যাক্ষর- ম এবং ট, কন্যা রাশির নামের আদ্যাক্ষর- প, থ, ষ এবং ণ, তুলা রাশির নামের আদ্যাক্ষর- র এবং ত, বৃশ্চিক রাশির নামের আদ্যাক্ষর- ন এবং য, ধনু রাশির নামের আদ্যাক্ষর- ধ এবং ভ, মকর রাশির নামের আদ্যাক্ষর- খ এবং জ, কুম্ভ রাশির নামের আদ্যাক্ষর- গ এবং শ এবং মীন রাশির নামের আদ্যাক্ষর- দ এবং চ। রবি, চন্দ্র আদি নয়টি গ্রহ এই বারটি রাশিতে পর্যায়ক্রমে ভ্রমণ করে। নয়টি গ্রহের মধ্যে সাতটি গ্রহ আবার বারটি রাশির অধিপতি। রবি সিংহ রাশির, চন্দ্র কর্কট রাশির, মঙ্গল মেষ ও বৃশ্চিক রাশির, বুধ মিথুন ও কন্যা রাশির, বৃহস্পতি ধনু ও মীন রাশির, শুক্র বৃষ ও তুলা রাশির এবং শনি মকর ও কুম্ভ রাশির অধিপতি।
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে জন্ম রাশি ফল
সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার চন্দ্র যে রাশিতে থাকে ঐ রাশিকে জন্ম-রাশি বলে। জ্যোতিষ শাস্ত্রে বর্ণিত আছে, মেষ রাশির জাতক ভাবপ্রবণ, চঞ্চল, জেদী, ক্রোধী, সামান্য কারণে আনন্দিত বা বিষাদগ্রস্ত, মিষ্টান্নপ্রিয়, ত্যাগী, ধনী, নিজ কর্মে বিশ্বাসী, প্রবল আত্মবোধ ও ইন্দ্রিয়ানুভূতির অধিকারী। বৃষ রাশির জাতক স্থুল নেত্রযুক্ত, স্বল্পভাষী, ধীর-স্থীর, ধার্মিক, কুলজনের হিতকারী, তীক্ষ্ণ-বুদ্ধিযুক্ত, অধ্যবসায়ী, পরিশ্রমী, স্থির-প্রতিজ্ঞ, বাস্তববাদী, আধিপত্য বিস্তারকারী ও হিসাবী।মিথুন রাশির জাতক ধীর-গতিসম্পন্ন, স্পষ্টবাক, পরহিতৈষী, তীক্ষ্ণ-বুদ্ধিযুক্ত, পণ্ডিত, হাস্যযুক্ত, কৌতুকপ্রিয়, আত্ম-প্রশংসাকামী, সমালোচক, গীতবাদ্য অনুরাগী। কর্কট রাশির জাতক চিন্তাশীল, ভাবুক, কল্পনাপ্রবন, উদার, সত্যবাদী, দয়ালু, দেবদ্বিজে ভক্তিপরায়ণ, পণ্ডিত, প্রগতিশীল হলেও পুরাতনপন্থী, দৃঢ়-প্রতীজ্ঞ, ভ্রমণপ্রিয়, আশ্চর্যজনক বিষয়ে আগ্রহশীল, মাতা-পিতার প্রতি ভক্তিপরায়ণ এবং সাহিত্য ও গীতবাদ্যে অনুরাগী। সিংহ রাশির জাতক বিশ্বাসী, ক্রোধী, বন্ধুহীন, উন্নত-বক্ষবিশিষ্ট, খেয়ালী, কর্তৃত্বপ্রিয়, স্বাধীনচেতা, বিলাসী, স্পষ্টবক্তা, অন্যায়ের বিরুদ্ধাচারী, আত্ম-সচেতন ও অমিতব্যয়ী। কন্যা রাশির জাতক ধার্মিক, বালক-স্বভাবযুক্ত, ক্ষমাপরায়ণ, একমনা, তীক্ষ্ণ-বুদ্ধিযুক্ত, সমালোচক, সৎ হলেও ক্ষেত্র বিশেষে কুটিল-স্বভাবযুক্ত, মাতৃভক্ত, সাহিত্য-রসিক এবং রমণীগণের প্রিয়। তুলা রাশির জাতক কোমল শরীর-বিশিষ্ট, দাতা, বন্ধুবৎসল, সদালাপী, অতিভাষী, দৈব-প্রভাবযুক্ত, বুদ্ধিমান, সামাজিক, ভোগী, বিলাসী, শাস্ত্রজ্ঞ, সঙ্গীতজ্ঞ ও রমণীগণের প্রিয়। বৃশ্চিক রাশির জাতক পণ্ডিত, দৃঢ়মতি, বলশালী, আত্মনির্ভরশীল, কর্মদক্ষ, গম্ভীর, জেদী, ক্রোধী, পরমত অসহিষ্ণু, সর্বদা উদ্বেগযুক্ত ও খলবুদ্ধিসম্পন্ন। ধনু রাশির জাতক নানা কীর্তিপরায়ণ, কুলগৌরবযুক্ত, বন্ধুলোকের হিতকামী, সূক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন, প্রভূত ধন-সম্পদযুক্ত, ধীর গতিসম্পন্ন, ধার্মিক, স্বাধীনচেতা, উচ্চাভিলাসী, কর্তৃত্বপ্রিয়, অহংকারী, ক্ষণক্রোধী, পিতৃধন ত্যাগী, গীতপ্রিয়, মীতব্যয়ী, কখনও ধীর আবার কখনও স্থীর, দ্বিধাভাবগ্রস্ত ও সন্দিগ্ধমনা। মকর রাশির জাতক তীক্ষ্ণ-বুদ্ধিযুক্ত, ধীর, আত্মাভিমানী, পরাক্রমযুক্ত, বন্ধুবৎসল, দ্বায়িত্বসম্পন্ন, ভোগবিলাসী, মন্ত্রণা ও বাদানুবাদে দক্ষ, সুনামপ্রিয়, পরদারাসক্ত এবং বাইরে থেকে সহজ-সরল মনে হলেও অমত্মরে কুটিল। কুম্ভ রাশির জাতক উদ্যমী, একাগ্র চিত্তের অধিকারী, ভাবুক, ধার্মিক, নির্জনতাপ্রিয়, সংস্কারপ্রিয়, জ্ঞাতিবর্গসহ আমোদকারী, পরদারাসক্ত, ধনশালী, গম্ভীর, কুটিল স্বভাবযুক্ত ও নিদ্রাপ্রিয়। মীন রাশির জাতকধৈর্যশালী, শামিত্মপ্রিয়, একাগ্র, জ্ঞানী, মানী, আশাবাদী, উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন, উদার, ধার্মিক, দ্বিধাভাবগ্রস্ত, স্ত্রী-জয়ী, রমণীপ্রিয়, সাহিত্যরসিক ও ধনেজনে সুখভোগী।
লগ্ন পরিচয়
এক দিবারাত্রের মধ্যে বারটি রাশি পর্যায়ক্রমে পূর্বদিকে উদিত হয়। রাশিসমূহের এই উদয়কালকে লগ্ন বলে। লগ্নকে অন্যভাবেও সংজ্ঞায়িত করা যায়। পৃথিবী নিজ কক্ষপথে ভ্রমণের সময় এক দিনে এর চতুর্দিকে অবস্থিত ১২টি রাশির প্রত্যেকটিকে নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে অতিক্রম করে ঐ নির্দিষ্ট সময়কে লগ্ন বলে। পৃথিবী যে সময় ব্যাপী যে রাশি অতিক্রম করে ঐ রাশির নাম অনুসারে ঐ লগ্নের নাম হয়। যেমন সূর্যোদয়ের পর দুই ঘণ্টা পর্যমত্ম যদি পৃথিবী মেষ রাশিকে অতিক্রম করতে থাকে তাহলে ঐ সময়কে বলা হবে মেষ লগ্ন এবং সূর্যোদয়ের দুই ঘণ্টা পর বৃষ লগ্ন শুরম্ন হবে। এভাবে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় পর পর বারটি লগ্ন আবর্তিত হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্রে উল্লিখিত বারটি লগ্নের নাম- ১) মেষ, ২) বৃষ, ৩) মিথুন, ৪) কর্কট, ৫) সিংহ, ৬) কন্যা, ৭) তুলা, ৮) ধনু, ৯) বৃশ্চিক, ১০) মকর, ১১) কুম্ভ ও ১২) মীন।
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে জন্ম-লগ্ন ফল
জন্মের সময় পৃথিবীর নিকটস্থ রাশিকে অর্থাৎ পৃথিবী যে রাশিকে অতিক্রম করছিল সে রাশিকে জন্ম-লগ্ন বলে। এখন সংক্ষিপ্তাকারে দ্বাদশ প্রকার জন্ম-লগ্নের ফল দেয়া যাক। জ্যোতিষ শাস্ত্রে বর্ণিত আছে, মেষ লগ্নের জাতক যশস্বী, মানী, পরবৎসল, জ্ঞানী, পরাক্রমশালী, সাহসী, ক্রোধী, কুটচিন্তাশীল, ভোগী ও স্ত্রীপুত্র সুখে সুখী হয়ে থাকে। বৃষ লগ্নের জাতক গুরুভক্ত, প্রিয়ভাষী, গুণবান, কৃতী, তেজস্বী, সর্বজনপ্রিয়, সুরতক্রিয়া নিপুন, লোভী ও পরস্ত্রীতে অনুরক্ত হয়ে থাকে। মিথুন লগ্নের জাতক মান্যগণ্য, যশস্বী, শিক্ষিত, আত্মীয়বৎসল, ত্যাগী, ভোগী, ধনী, কামী, দীর্ঘসূত্রী, সাহিত্যরসিক,সঙ্গীতজ্ঞ, সুবক্তা হয়ে থাকে। কর্কট লগ্নের জাতক সর্বজনপ্রিয়, স্বজনপ্রিয়, ধার্মিক, ধনী, ভোগী, পণ্ডিত, ভাষাবিদ, জনসেবক এবং মিষ্টান্ন ও পানীয় দ্রব্যপ্রিয় হয়ে থাকে। সিংহ লগ্নের জাতক শত্রুজয়ী, বুদ্ধিমান, উৎসাহী, বলশালী, পরদ্রব্যভোগী, ক্রোধী, স্বল্পপুত্রবিশিষ্ট, জনপ্রিয় ও স্বার্থহীন হয়ে থাকে। কন্যা লগ্নের জাতক ধার্মিক, জ্ঞানী, শাস্ত্রজ্ঞ, বিচক্ষণ, অহংকারী, পর্যটক, বক্তা, কামকলাপ্রিয়, সৌভাগ্যশালী ও স্বল্পাহারী হয়ে থাকে। তুলা লগ্নের জাতক ধীর-স্থির, বহুজনের হিতকারী, বিদ্বান, সৎকর্মে অনুরক্ত, ধনী, মানী, শিল্পকলায় পরিদর্শী ও অল্পভোগী হয়ে থাকে। বৃশ্চিক লগ্নের জাতক শৌর্যশালী, বুদ্ধিমান, সৌভাগ্যযুক্ত, ক্রোধী, কামুক, সাহসী, ক্ষুধাতুর, বিবাদকারী ও দুষ্টবুদ্ধিযুক্ত হয়ে থাকে। ধনু লগ্নের জাতক নীতিপরায়ণ, ধার্মিক, শাণিতবাক, বিদ্বান, ধনী, সুখী, জ্ঞানী, বহুলোকের হিতকারী, চাপা-স্বভাব, অহংকারী ও উচ্চাভিলাসী হয়ে থাকে। মকর লগ্নের জাতক যশস্বী, ধনী, বহুসন্তানযুক্ত, কপট, কর্মঠ, কষ্টসহিষ্ণু, লোভী, হীনকর্মযুক্ত ও স্বকার্যে তৎপর হয়ে থাকে। কুম্ভ লগ্নের জাতক বলশালী, সুখী, বন্ধুযুক্ত, বেদজ্ঞ, সূক্ষ্ম অনুভূতিশীল, তপস্বী, ক্রোধী, চঞ্চল, পরস্ত্রীতে আসক্ত ও নিদ্রালু হয়ে থাকে। মীন লগ্নের জাতক অতিশয় জ্ঞানী, দেবতা ও গুরু-পূজক, মানী, ধনী, স্পর্শকাতর, নিঃসঙ্গ জীবনীশক্তিযুক্ত, স্বল্প রোমবিশিষ্ট ও বহুকাল পরীক্ষাকারী হয়ে থাকে।
তিথি পরিচয়
জ্যোতিষ বিজ্ঞান মতে চন্দ্র পৃথিবীর চতুর্দিকে একবার প্রদক্ষিণ করতে ত্রিশ দিন লাগে। চন্দ্র ও পৃথিবী ঘুর্ণনের ফলে চন্দ্র ক্রমশ দৃশ্যমান হতে হতে পনের দিনে সম্পূর্ণ দৃশ্যমান হয় যাকে পূর্ণিমা বলে এবং পরবর্তী পনের দিন পর সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয় যাকে অমাবস্যা বলে। যে একক সময়ে চন্দ্রের এরকম হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে তাকে প্রতিপদ, দ্বিতীয়া আদি তিথি বলে। অমাবস্যার পরের দিন অর্থাৎ প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পনের দিন শুক্ল পক্ষ এবং পূর্ণিমার পরের দিন অর্থাৎ প্রতিপদ থেকে অমাবশ্যা পর্যমত্ম পনের দিন কৃষ্ণ পক্ষ নামে পরিচিত। শুক্ল পক্ষের তিথির নাম- ১) প্রতিপদ, ২) দ্বিতীয়া, ৩) তৃতীয়া, ৪) চতুর্থী, ৫) পঞ্চমী, ৬) ষষ্ঠী, ৭) সপ্তমী, ৮) অষ্টমী, ৯) নবমী, ১০) দশমী, ১১) একাদশী, ১২) দ্বাদশী, ১৩) ত্রয়োদশী, ১৪) চতুর্দশী ও ১৫) পূর্ণিমা। কৃষ্ণ পক্ষের তিথির নাম- ১৬) প্রতিপদ, ১৭) দ্বিতীয়া, ১৮) তৃতীয়া, ১৯) চতুর্থী, ২০) পঞ্চমী, ২১) ষষ্ঠী, ২২) সপ্তমী, ২৩) অষ্টমী, ২৪) নবমী, ২৫) দশমী, ২৬) একাদশী, ২৭) দ্বাদশী, ২৮) ত্রয়োদশী, ২৯) চতুর্দশী ও ৩০) অমাবস্যা। তিথিসমূহ পাঁচ ভাগে বিভক্ত, যথা- নন্দা, ভদ্রা, জয়া, রিক্তা ও পূর্ণা। প্রতিপদ, ষষ্ঠী ও একাদশীকে নন্দা; দ্বিতীয়া, সপ্তমী ও দ্বাদশীকে ভদ্রা; তৃতীয়া, অষ্টমী ও ত্রয়োদশীকে জয়া; চতুর্থী, নবমী ও চতুর্দশীকে রিক্তা এবং পঞ্চমী, দশমী, অমাবস্যা ও পূর্ণিমাকে পূর্ণা বলে।
নক্ষত্র পরিচয়
মহাকাশে অগণিত নক্ষত্র রয়েছে। তার মধ্যে পৃথিবীর উপর সাতাশটি নক্ষত্রের প্রভাব বিদ্যমান। জ্যোতিষ শাস্ত্রে উল্লিখিত সাতাশটি নক্ষত্রের নাম- ১) অশ্বিনী, ২) ভরণী, ৩) কৃত্তিকা, ৪) রোহিণী, ৫) মৃগশিরা, ৬) আর্দ্রা, ৭) পুনর্বসু, ৮) পুষ্যা, ৯) অশ্লেষা, ১০) মঘা, ১১) পূর্ব-ফাল্গুনী, ১২) উত্তর-ফাল্গুনী, ১৩) হস্তা, ১৪) চিত্রা, ১৫) স্বাতী, ১৬) বিশাখা, ১৭) অনুরাধা, ১৮) জ্যেষ্ঠা, ১৯) মূলা, ২০) পূর্বাষাঢ়া, ২১) উত্তরাষাঢ়া, ২২) শ্রবণা, ২৩) ধনিষ্ঠা, ২৪) শতভিষা, ২৫) পূর্ব-ভাদ্রপদ, ২৬) উত্তর-ভাদ্রপদ ও ২৭) রেবতী। হিন্দু-পুরাণ মতে এই সাতাশটি নক্ষত্র কোন দীপ্তিমান জড় বস্ত্ত নয়। প্রকৃতক্ষে এই সাতাশটি নক্ষত্র মূলত দক্ষের সাতাশ কন্যা। চন্দ্র এই সাতাশ কন্যাকে বিবাহ করেছেন। যা হোক, চন্দ্র পর্যায়ক্রমে একটি ন্ত্রে একদিন অবস্থান করেন। চন্দ্র ব্যতীত অন্যান্য গ্রহগণও সাতাশটি নক্ষত্রকে পর্যায়ক্রমে নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে অতিক্রম করেন। নক্ষ ত্রসমূহকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন, উগ্রগণ- পূর্ব-ফাল্গুনী, পূর্বাষাঢ়া, পূর্ব-ভাদ্রপদ, মঘা ও ভরণী নক্ষত্র। ধ্রুবগণ- উত্তর-ফাল্গুনী, উত্তরাষাঢ়া, উত্তর-ভাদ্রপদ ও রোহিণী নক্ষত্র। চরগণ- স্বাতী, পুনর্বসু, শ্রবণা, ধনিষ্ঠা ও শতভিষা নক্ষত্র। ক্ষিপ্রগণ- পুষ্যা, অশ্বিনী ও হস্তা নক্ষত্র। মৃদুগণ- চিত্রা, অনুরাধা, মৃগশিরা ও রেবতী নক্ষত্র। তীক্ষ্ণগণ- আর্দ্রা, অশ্লেষা, জ্যেষ্ঠা ও মূলা নক্ষত্র। মিশ্রগণ- কৃত্তিকা ও বিশাখা।
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে তারাশুদ্ধি
জাতকের জন্ম-নক্ষত্র থেকে নয়টি করে তারা বা নক্ষত্রকে যথাক্রমে জন্ম, সম্পদ, বিপদ, ক্ষেম, প্রত্যারি, সাধক, বধ, মিত্র ও পরমমিত্র নাড়ি বলা হয়। জ্যোতিষ বিজ্ঞান মতে যদি জাতকের অশ্বিনী অর্থাৎ ১ নং নক্ষত্রে জন্ম হয়, তবে ১ নং জন্ম, ২ নং সম্পদ, ৩ নং বিপদ এই ক্রমে ৯ নং পরমমিত্র নাড়ি হবে এবং ১০ নং আবার জন্ম নাড়ি হবে; এভাবে ২৭টি তারা নয় প্রকার নাড়িতে অবস্থান করবে। এই নিয়মে যদি ১০ নং নক্ষত্রে জন্ম হয় তবে ১০, ১৯ ও ১ নং তারাকে জন্ম নাড়ি, ১১, ২০ ও ২ নং তারাকে সম্পদ নাড়ি, ১২, ২১ ও ৩ নং তারাকে বিপদ নাড়ি, ১৩, ২২ ও ৪ নং তারাকে ক্ষেম নাড়ি, ১৪, ২৩ ও ৫ নং তারাকে প্রত্যারি নাড়ি, ১৫, ২৪ ও ৬ নং তারাকে সাধক নাড়ি, ১৬, ২৫ ও ৭ নং তারাকে বধ নাড়ি, ১৭, ২৬ ও ৮ নং তারাকে মিত্র নাড়ি এবং ১৮, ২৭ ও ৯ নং তারাকে পরমমিত্র নাড়ি বলা হয়। ৯টি নাড়ির মধ্যে বিপদ, প্রত্যারি ও বধ এই ৩টি নাড়ি অশুভ এবং অবশিষ্ট ৬টি নাড়ি শুভ। অশুভ নাড়ি যে দিন থাকবে ঐদিন বিবাহ আদি মাঙ্গলিক কর্ম বর্জনীয়। জন্ম নাড়ি ভিন্ন অন্যান্য শুভ নাড়িতে বিবাহ, শ্রাদ্ধ, যাত্রা ও ক্ষৌরী কর্ম প্রশস্ত।
করণ পরিচয়
প্রত্যেক তিথির পূর্বার্ধে ও শেষার্ধে একটি করে মোট দুইটি করণ থাকে। সাতটি চর-করণ (গতিশীল বা অস্থির করণ) ও চারটি ধ্রুব-করণ (স্থির করণ) সহ মোট এগারটি করণ রয়েছে, যথা- (ক) চর-করণ- ১) বব করণ, ২) বালব করণ, ৩) কৌলব করণ, ৪) তৈতিল করণ, ৫) গর করণ, ৬) বণিজ করণ, ৭) বিষ্টি করণ। (খ) ধ্রব-করণ- ৮) শকুনি করণ, ৯) চতুষ্পাদ করণ, ১০) নাগ করণ, ১১) কিন্তুঘ্ন করণ। শুক্লপক্ষে প্রতিপদের শেষার্ধ হতে পর পর তিথির পূর্বার্ধ ও শেষার্ধ অনুসারে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী পর্যন্ত ২৯টি তিথির মোট ৫৬টি অর্ধাংশে ৭টি চর-করণ নির্দিষ্ট ক্রমে ৪ বার আবর্তিত হয়। অর্থাৎ শুক্লপক্ষের প্রতিপদের শেষার্ধে বব, দ্বিতীয়ার পূর্বার্ধে বালব ও শেষার্ধে কৌলব, তৃতীয়ার পূর্বার্ধে তৈতিল ও শেষার্ধে গর, চতুর্থীর পূর্বার্ধে বণিজ ও শেষার্ধে বিষ্টি করণ হয় আবার পঞ্চমীর পূর্বার্ধ থেকে বব করণ শুরু হয় এবং এই ক্রমে আবর্তিত হতে হতে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে বিষ্ট করণ হয়। একই নিয়মে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর শেষার্ধ হতে তিথির পূর্বার্ধ ও শেষার্ধ অনুসারে শুক্লপক্ষের প্রতিপদের পূর্বার্ধ পর্যন্ত ধ্রুব-করণ গণনা করা হয়।
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে বিষ্টিভদ্রা করণ পরিচয়
শুক্লপক্ষের একাদশী ও চতুর্থীর শেষার্ধ, অষ্টমী ও পূর্ণিমার পূর্বার্ধ এবং কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয় ও দশমীর শেষার্ধ, সপ্তমী ও চতুর্দশীর পূর্বার্ধকে বিষ্টিভদ্রা বলে। কর্কট, সিংহ, কুম্ভ ও মীন রাশিতে বিষ্টিভদ্রা হলে বিষ্টি পৃথিবীতে বাস করে। মেষ, বৃষ, মিথুন ও বৃশ্চিক রাশিতে বিষ্টিভদ্রা হলে বিষ্টি স্বর্গে বাস করে। কন্যা, তুলা, ধনু ও মকর রাশিতে বিষ্টিভদ্রা হলে বিষ্টি পাতালে বাস করে। বিষ্টিভদ্রায় বিষ্টি পৃথিবীতে বাস করলে সকল কার্য নাশ, বিষ্টি স্বর্গে বাস করলে সকল কার্য সিদ্ধি এবং বিষ্টি পাতালে বাস করলে ধনবৃদ্ধি ঘটে। বিষ্টিভদ্রা মোট ১২ ঘণ্টা বা ৩০ দণ্ড অবস্থান করে। বিষ্টিভদ্রার ৩০ দণ্ডের প্রথম ৫ দণ্ডকে মুখ, পরের ১ দণ্ডকে কণ্ঠ, পরের ১১ দণ্ডকে বক্ষ, পরের ৪ দণ্ডকে নাভি, পরের ৬ দণ্ডকে কটি এবং শেষ ৩ দণ্ডকে পুচ্ছ বলে। বিষ্টিভদ্রার মুখে কর্ম করলে কার্যহানি, কণ্ঠে মৃত্যু, বক্ষ ধনহানি, নাভিতে কলহ, কটিতে বুদ্ধিনাশ এবং পুচ্ছে কর্ম করলে বিজয় বা সিদ্ধিলাভ হয়।
যোগ পরিচয়
জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুসারে মোট সাতাশটি যোগ রয়েছে। প্রতিদিন একটি করে যোগ থাকে এবং এই যোগসমূহ পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়। সাতাশটি যোগের নাম- ১) বিকুম্ভ, ২) প্রীতি, ৩) আয়ুষ্মান, ৪) সৌভাগ্য, ৫) শোভন, ৬) অতিগ-, ৭) সুকর্মা, ৮) ধৃতি, ৯) শূল, ১০) গ-, ১১) বৃদ্ধি, ১২) ধ্রুব, ১৩) ব্যাঘাত, ১৪) হর্ষণ, ১৫) বজ্র, ১৬) অসৃক, ১৭) ব্যতীপাত, ১৮) বরীয়ান্, ১৯) পরিঘ, ২০) শিব, ২১) সাধ্য, ২২) সিদ্ধ, ২৩) শুভ, ২৪) শুক্র, ২৫) ব্রহ্ম, ২৬) ইন্দ্র ও ২৭) বৈধৃতি। পরিঘ যোগের প্রথমার্ধ, বিকুম্ভ যোগের ১ম ৫ দ-, শূল যোগের ১ম ৭ দ-, গ- ও ব্যাঘাত যোগের ১ম ৬ দ-, হর্ষণ ও বজ্র যোগের ১ম ৯ দণ্ড এবং বৈধৃতি ও ব্যতীপাত যোগের সমসত্ম কাল পরিত্যাগ করে শুভকর্ম করলে তা সফল হয়। অন্য যোগসমূহ তাদের নাম অনুসারে ফল প্রদান করে। যেমন- সৌভাগ্য যোগে সৌভাগ্য বৃদ্ধি ঘটে, সিদ্ধ যোগে কার্যসিদ্ধি ঘটে প্রভৃতি।
জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী সময়ের হিসাব
চোখের পাতা পড়তে যে সময় লাগে তাকে নিমেষ বলে। ১৫ নিমেষে ১ কাষ্ঠা, ৩০ কাষ্ঠায় ১ কলা এবং ৩০ কলায় এক মুহূর্ত, ৩০ মুহূর্তে ১ দিবা-রাত্র হয়। ৭ দিবা-রাত্রে ১ সপ্তাহ, ১৫ দিবা-রাত্রে ১ পক্ষ এবং ৩০ দিবা-রাত্রে এক মাস হয়। ৩৬৫ দিবা-রাত্রে বা ১২ মাসে ১ বৎসর হয়। আবার ৬০ বিপলে ১ পল, ৬০ পলে ১ দণ্ড, ২ দণ্ডে ১ মুহূর্ত এবং ৬০ দণ্ডে ১ দিবা-রাত্র। আধুনিক নিয়মে ৬০ সেকেণ্ডে ১ মিনিট, ৬০ মিনিটে ১ ঘণ্টা এবং ২৪ ঘণ্টায় এক দিবা-রাত্র। তাই ঘণ্টার হিসাবে সোয়া মুহূর্তে ১ ঘণ্টা বা ৪৮ মিনিটে ১ মুহূর্ত এবং আড়াই দণ্ডে ১ ঘণ্টা বা ২৪ মিনিটে ১ দ-। এক দিবা-রাত্রের আট ভাগের এক ভাগ সময়কে প্রহর বলে। ঘণ্টার হিসাবে ৩ ঘণ্টায় ১ প্রহর এবং ৮ প্রহরে এক দিন। যামার্ধ দুটি, যথা- দিবা ও রাত্রি যামার্ধ। দিনমানের আট ভাগের এক ভাগ সময়কে দিবা-যামার্ধ এবং রাত্রিমানের আট ভাগের এক ভাগ সময়কে রাত্রি-যামার্ধ বলে অর্থাৎ ৮ দিবা-যামার্ধে ১ দিন এবং ৮ রাত্রি-যামার্ধে ১ রাত হয়। দিনমান বা রাত্রিমান বার ঘণ্টা হলে দেড় ঘণ্টায় এক যামার্ধ হয়।
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে বার, পক্ষও মাস পরিচয়
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে একটি সপ্তাহে সাতটি বার রয়েছে, যথা- রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি বার। সোম, বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্র এই চারটি বার সর্বকার্যে শুভ এবং শনি, রবি ও মঙ্গল এই তিনটি বার অশুভ। পক্ষ দুটি, যথা- শুক্ল ও কৃষ্ণ পক্ষ। বার মাসে এক বছর হয়। বারটি মাসের নাম- ১) বৈশাখ, ২) জ্যৈষ্ঠ, ৩) আষাঢ়, ৪) শ্রাবণ, ৫) ভাদ্র, ৬) আশ্বিন, ৭) কার্তিক, ৮) অগ্রহায়ণ, ৯) পৌষ, ১০) মাঘ, ১১) ফাল্গুন এবং ১২) চৈত্র।
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে বারবেলা, কালবেলা ও কালরাত্রি
রবি বারে দিনের ৪র্থ ও ৫ম, সোম বারে ২য় ও ৭ম, মঙ্গল বারে ৬ষ্ঠ ও ২য়, বুধ বারে ৫ম ও ৩য়, বৃহস্পতি বারে ৭ম ও ৮ম, শুক্র বারে ৩য় ও ৪র্থ এবং শনি বারে ১ম, ৬ষ্ঠ ও ৮ম যামার্ধকে বারবেলা ও কালবেলা বলে। রবি বারে রাত্রির ৬ষ্ঠ, সোম বারে ৪র্থ, মঙ্গল বারে ২য়, বুধ বারে ৭ম, বৃহস্পতি বারে ৫ম, শুক্র বারে ৩য় এবং শনি বারে ১ম ও ৮ম যামার্ধকে কালরাত্রি বলে। কালবেলা ও কালরাত্রিতে যাত্রা এবং বিবাহ, উপনয়ন আদি শুভকর্ম পরিত্যাগ করা উচিত।
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে মাসদগ্ধা, চন্দ্রদগ্ধা, ত্র্যস্পর্শ ও মল-মাস কথন
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে বৈশাখ মাসের শুক্লা ৬ষ্ঠী, জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা ৪র্থী, আষাঢ় মাসের শুক্লা ৮মী, শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণা ৬ষ্ঠী, ভাদ্র মাসের শুক্লা ১০মী, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা ৮মী, কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বাদশী, অগ্রহায়ণ মাসের কৃষ্ণা ১০মী, পৌষ মাসের শুক্লা ২য়া, মাঘ মাসের কৃষ্ণা ১২শী, ফাল্গুন মাসের শুক্লা ৪র্থী এবং চৈত্র মাসের কৃষ্ণা ২য়া তিথিকে মাসদগ্ধা বলে। চন্দ্র শুক্লপক্ষের ২য়া তিথিতে ধনু রাশিতে, ৪র্থী তিথিতে কুম্ভ রাশিতে, ৬ষ্ঠী তিথিতে মেষ রাশিতে, ৮মী তিথিতে মিথুন রাশিতে, দশমী তিথিতে সিংহ রাশিতে ও ১২শী তিথিতে তুলা রাশিতে এবং চন্দ্র কৃষ্ণ পক্ষের ২য়া তিথিতে মীন রাশিতে, ৪র্থী তিথিতে বৃষ রাশিতে, ৬ষ্ঠী তিথিতে কর্কট রাশিতে, ৮মী তিথিতে কন্যা রাশিতে, ১০মী তিথিতে বৃশ্চিক রাশিতে ও ১২শী তিথিতে মকর রাশিতে অবস্থান করলে চন্দ্রদগ্ধা হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্রে অধম, ত্র্যস্পর্শ ও মল-মাস বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। একদিনে অর্থাৎ এক দিবা-রাত্রে দুই তিথির অমত্ম হলে ঐ দিনকে অবম বলে। একদিনে তিন তিথি অবস্থান করলে ঐ দিনকে ত্র্যস্পর্শ বলে। যে মাসে দুইটি অমাবশ্যা হয় ঐ মাসকে মল-মাস বলে। অধম ও ত্র্যস্পর্শে যাত্রা ও বিবাহ আদি শুভকর্ম নিষিদ্ধ। মল মাসেও বিবাহ আদি শুভকর্ম করা অনুচিত।
তিথি সংশ্লিষ্ট যোগ
জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুসারে শুক্র বারে নন্দা, বুধ বারে ভদ্রা, মঙ্গল বারে জয়া, শনি বারে রিক্তা এবং বৃহস্পতি বারে পূর্ণা তিথি হলে সিদ্ধি-যোগহয়। রবি ও সোম বারে পূর্ণা, মঙ্গল বারে ভদ্রা, বৃহস্পতি বারে জয়া, বুধ ও শনি বারে নন্দা এবং শুক্র বারে রিক্তা তিথি হলে তিথ্যামৃত-যোগহয়। রবি ও মঙ্গল বারে নন্দা, সোম ও শুক্র বারে ভদ্রা, বুধ বারে জয়া, বৃহস্পতি বারে রিক্তা এবং শনি বারে পূর্ণা তিথি হলে পাপযোগ হয়। রবি বারে দ্বাদশী, সোম বারে একাদশী, মঙ্গল বারে দশমী, বুধ বারে তৃতীয়া, বৃহস্পতি বারে ষষ্ঠী, শুক্র বারে দ্বিতীয়া এবং শনি বারে তৃতীয়া হলে দিনদগ্ধা বা তিথিদগ্ধা-যোগ হয়। রবি বারে দ্বাদশী ও মঘা, সোম বারে একাদশী ও কৃত্তিকা, মঙ্গল বারে দশমী ও আদ্রা, বুধ বারে তৃতীয়া ও মূলা, বৃহস্পতি বারে ষষ্ঠী ও ভরণী, শুক্র বারে দ্বিতীয়া ও অশ্বিনী এবং শনি বারে সপ্তমী ও অশেস্নষা হলে মহাদগ্ধা হয়। সোম বারে ষষ্ঠী, শুক্র বারে সপ্তমী, বৃহস্পতি বারে অষ্টমী, বুধ বারে নবমী, শনি বারে দশমী, মঙ্গল বারে একাদশী এবং রবি বারে দ্বাদশী তিথি হলে কালঘণ্টা-যোগ হয়। রবি বারে দ্বাদশী, সোম বারে একাদশী, মঙ্গল বারে দশমী, বুধ বারে নবমী, বৃহস্পতি বারে অষ্টমী, শুক্র বারে সপ্তমী এবং শনি বারে ষষ্ঠী তিথি হলে ক্রকচ-যোগ হয়। সোম বারে প্রতিপদ ও ষষ্ঠী, বৃহস্পতি বারে ভদ্রা, রবি ও শনি বারে জয়া, মঙ্গল বারে রিক্তা এবং বুধ ও শুক্র বারে পূর্ণা তিথি হলে রত্নাঙ্কুর-যোগ হয়।
নক্ষত্র সংশ্লিষ্ট যোগ
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে রবি বারে উত্তর-ফাল্গুনী, উত্তরাষাঢ়া, উত্তর-ভাদ্রপদ, রোহিণী, পুষ্যা, হস্তা, মূলা ও রেবতী; সোম বারে শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, রোহিণী, মৃগশিরা, পূর্ব-ফাল্গুনী, উত্তর-ফাল্গুনী, পূর্ব-ভাদ্রপদ, উত্তর-ভাদ্রপদ, হসত্মা ও অশ্বিনী; মঙ্গল বারে পুষ্যা, অশ্লেষা, কৃত্তিকা, স্বাতী, উত্তর-ভাদ্রপদ ও রেবতী; বুধ বারে কৃত্তিকা, রোহিণী, অনুরাধা, শতভিষা; বৃহস্পতি বারে স্বাতী, পুনর্বসু, পুষ্যা ও অনুরাধা; শুক্র বারে পূর্ব-ফাল্গুনী, উত্তর-ফাল্গুনী, পূর্ব-ভাদ্রপদ, উত্তর-ভাদ্রপদ, অশ্বিনী, শ্রবণা ও অনুরাধা এবং শনি বারে স্বাতী ও রোহিণী নক্ষত্র হলে নক্ষত্রামৃত-যোগ হয়। সিদ্ধি ও নক্ষত্রামৃত যোগ যদি একইদিনের যে কোন সময় মিলিত হয়, তবে তাকে বিষযোগ বলে। রবি ও মঙ্গল বারে নন্দা তিথি ও স্বাতী, শতভিষা, আর্দ্রা, রেবতী, চিত্রা, অশ্লেষা, মূলা ও কৃত্তিকা নক্ষত্র, শুক্র ও সোম বারে ভদ্রা তিথি ও পূর্ব-ফাল্গুনী, উত্তর-ফাল্গুনী, পূর্ব-ভাদ্রপদ ও উত্তর-ভাদ্রপদ নক্ষত্র, বুধ বারে জয়া তিথি ও মৃগশিরা, শ্রবণা, পুষ্যা, জ্যেষ্ঠা, অশ্বিনী, ভরণী ও অভিজিৎ নক্ষত্র, বৃহস্পতি বারে রিক্তা তিথি ও পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া, বিশাখা, অনুরাধা, পুনর্বসু, মঘা,নক্ষত্র এবং শনি বারে পূর্ণা তিথি ও রোহিণী, হস্তা ও ধনিষ্ঠা নক্ষত্র হলে ত্র্যমৃতযোগ হয়। রবি বারে অশ্বিনী, সোম বারে চিত্রা, মঙ্গল বারে উত্তরাষাঢ়া, বুধ বারে মূলা, বৃহস্পতি বারে শতভিষা, শুক্র বারে পুষ্যা এবং শনি বারে ভরণী নক্ষত্র হলে ক্রকচ-যোগ হয়।
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে বর্ণ ও গণ
রাশি অনুসারে বর্ণ এবং নক্ষত্র অনুসারে গণ নির্ণয় করা হয়। কর্কট, বৃশ্চিক ও মীন রাশির জাতক বিপ্র-বর্ণ, সিংহ, তুলা ও ধনু রাশির জাতক ক্ষত্রিয়-বর্ণ, মেষ, মিথুন ও কুম্ভ রাশির জাতক বৈশ্য-বর্ণ এবং বৃষ, কন্যা ও মকর রাশির জাতক শূদ্র-বর্ণ লাভ করে। হসত্মা, স্বাতী, মৃগশিরা, অশ্বিনী, শ্রবণা, পুষ্যা, রেবতী, অনুরাধা ও পুনর্বসু নক্ষত্রে জন্মগ্রহণ করলে দেবগণ হয়। রোহিণী, আর্দ্রা, উত্তর-ফাল্গুনী, উত্তরাষাঢ়া, উত্তর-ভাদ্রপদ, ভরণী, পূর্ব-ফাল্গুনী, পূর্বাষাঢ়া ও পূর্ব-ভাদ্রপদ নক্ষত্রে জন্মগ্রহণ করলে নরগণ হয়। কৃত্তিকা, অশ্লেষা, মঘা, চিত্রা, বিশাখা, জ্যেষ্ঠা, মূলা, ধনিষ্ঠা শতভিষা নক্ষত্রে জন্মগ্রহণ করলেদেবারি বা রাক্ষসগণ হয়।
অষ্টোত্তরী ও বিংশোত্তরী জন্ম-দশা
জন্ম-নক্ষত্র অনুসারে জাতককে বিভিন্ন গ্রহের দশা ভোগ করতে হয়। জ্যোতিষ-শাস্ত্রে দুই প্রকার দশা প্রচলিত, যথা- অষ্টোত্তরী ও বিংশোত্তরী দশা। জাতক কৃষ্ণপক্ষে দিনে ও শুক্লপক্ষে রাতে জন্মগ্রহণ করলে বিংশোত্তরী দশা এবং কৃষ্ণপক্ষে রাতে ও শুক্লপক্ষে দিনে জন্মগ্রহণ করলে অষ্টোত্তরী দশা প্রযোজ্য হবে। অষ্টোত্তরী নিয়মে জাতক রবি (৬ বছর), চন্দ্র (১৫ বছর), মঙ্গল (৮ বছর), বুধ (১৭ বছর), শনি (১০ বছর), বৃহস্পতি (১৯ বছর), রাহু (১২ বছর) ও শুক্র (২১ বছর) এই আটটি গ্রহের দশা নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে উক্ত ক্রমে ভোগ করবে। যেমন- কেউ রবির দশায় জন্মগ্রহণ করলে তাকে রবির দশার ভোগ্যকাল শেষে ১৫ বছর চন্দ্রের দশা ভোগ করতে হবে এবং এরপর তাকে ৮ বছর মঙ্গলের দশা ভোগ করতে হবে, এভাবে মৃত্যর পূর্ব পর্যমত্ম তাকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন গ্রহের দশা ভোগ করে যেতে হবে।
অষ্টোত্তরী মতে জন্ম-নক্ষত্র কৃত্তিকা, রোহিণী ও মৃগশিরা হলে প্রথমে রবির দশা হবে, আর্দ্রা, পুনর্বসু, পুষ্যা ও অশেস্নষা হলে প্রথমে চন্দ্রের দশা হবে, মঘা, পূর্ব-ফাল্গুনী ও উত্তর-ফাল্গুনী হলে প্রথমে মঙ্গলের দশা হবে, হসত্মা, চিত্রা, স্বাতী ও বিশাখা হলে প্রথমে বুধের দশা হবে, অনুরাধা, জ্যেষ্ঠা ও মূলা হলে প্রথমে শনির দশা হবে, পূর্বাষাঢ়া, উত্তরাষাঢ়া, শ্রবণা হলে প্রথমে বৃহস্পতির দশা হবে, ধনিষ্ঠা, শতভিষা ও পূর্ব-ভাদ্রপদ হলে প্রথমে রাহুর দশা হবে এবং উত্তর-ভাদ্রপদ, রেবতী, অশ্বিনী ও ভরণী হলে প্রথমে শুক্রের দশা হবে।
বিংশোত্তরী মতে, জাতক রবি (৬ বছর), চন্দ্র (১০ বছর), মঙ্গল (৭ বছর), রাহু (১৮ বছর), বৃহস্পতি (১৬ বছর), শনি (১৯ বছর), বুধ (১৭ বছর), কেতু (৭ বছর) ও শুক্র (২০ বছর) এই নয়টি গ্রহের দশা নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে উক্ত ক্রমে ভোগ করবে। কৃত্তিকা, উত্তর-ফাল্গুনী ও উত্তরাষাঢ়া জন্ম-নক্ষত্র হলে প্রথমে রবির দশা হবে, রোহিণী, হসত্মা ও শ্রবণা হলে প্রথমে চন্দ্রের দশা হবে, মৃগশিরা, চিত্রা ও ধনিষ্ঠা হলে প্রথমে মঙ্গলের দশা হবে, আর্দ্রা, স্বাতী ও শতভিষা হলে প্রথমে রাহুর দশা হবে, পুনর্বসু, বিশাখা ও পূর্ব-ভাদ্রপদ হলে প্রথমে বৃহস্পতির দশা হবে, পুষ্যা, অনুরাধা ও উত্তর-ভাদ্রপদ হলে প্রথমে শনির দশা হবে, অশেস্নষা, জ্যেষ্ঠা ও রেবতী হলে প্রথমে বুধের দশা হবে, মঘা, মূলা ও অশ্বিনী হলে প্রথমে কেতুর দশা হবে এবং পূর্ব-ফাল্গুনী, পূর্বাষাঢ়া ও ভরণী হলে প্রথমে শুক্রের দশা হবে।
এখন অষ্টোত্তরী মতে প্রথম দশার ভোগ্যকাল নির্ণয় প্রসঙ্গে আসা যাক। ধরা যাক, কোন জাতক রোহিণী নক্ষত্রের ৩০ দণ্ডে (১২ ঘণ্টা) জন্মগ্রহণ করেছেন। যেহেতু কৃত্তিকা, রোহিণী ও মৃগশিরা নক্ষত্রে জন্মগ্রহণ করলে জাতকের প্রথমে রবির দশা হয় সেহেতু ঐ জাতক রোহিণী নক্ষত্রে জন্মগ্রহণ করায় তাকে প্রথমে রবির দশা ভোগ করতে হবে। এখন ৩টি নক্ষত্রের জন্য রবির মোট ভোগ্য বছর ৬। তাহলে প্রতিটি নক্ষত্রকে রবি ৬/৩ = ২ বছর করে ভোগ করে। রোহিনী নক্ষত্রের স্থিতিকাল ৬০ দণ্ড (২৪ ঘণ্টা)। বর্তমান নক্ষত্র যে সময় পর্যমত্ম অবস্থান করে তা থেকে পূর্ববর্তী নক্ষত্র যে সময় পর্যন্ত অবস্থান করেছিল তা বিয়োগ করলেই নক্ষত্রে স্থিতিকাল পাওয়া যাবে। যেহেতু ৩০ দণ্ড পর জন্ম হয়েছে সেহেতু সে ৬০ – ৩০ = ৩০ দণ্ড ভোগ করবে। এখন সম্পূর্ণ নক্ষত্র ভোগের জন্য অর্থাৎ ৬০ দণ্ডের জন্য রবির ভোগ্যকাল ২ বছর হলে ৩০ দণ্ডের জন্য রবির ভোগ্যকাল হবে ১ বছর। জন্মের ১ বছর পর রবির ভোগ্যকাল শেষে চন্দ্রের দশা শুরু হবে যা ১০ বছর পর্যন্ত থাকবে।
বিংশোত্তরী মতে কোন জাতকের জন্ম রোহিনী নক্ষত্রে হলে তাকে প্রথমে চন্দ্রের দশা ভোগ করতে হবে। রোহিনী নক্ষত্রের ২৪ দ– জন্ম হলে তার নক্ষত্র ভোগ্যকাল হবে ৬০ – ২৪ = ৩৬ দণ্ড। এখন ৬০ দণ্ডের জন্য চন্দ্রের ভোগ্যকাল ১০ বছর হলে ৩৬ দণ্ডের জন্য চন্দ্রের ভোগ্যকাল হবে ৬ বছর। জন্মের ৬ বছর পর চন্দ্রের ভোগ্যকাল শেষে মঙ্গলের দশা শুরু হবে যা ৭ বছর পর্যন্ত থাকবে এবং এভাবে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দশা ভোগ চলতে থাকবে।
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে লগ্ন-বিচার ও দ্বাদশ ভাব ফল
জন্ম-লগ্নের ১ম, ৪র্থ, ৭ম ও ১০ম স্থানকে কেন্দ্র বলে। যেমন মেষ লগ্নের নক্ষত্রে ১ম স্থানে মেষ, ৪র্থ স্থান কর্কট, ৭ম স্থানে তুলা এবং ১০ম স্থানে মকর রয়েছে। সুতরাং ১ম স্থানে, কর্কটের স্থানে, তুলার স্থানে এবং মকরের স্থানে কোন গ্রহ থাকলে তা কেন্দ্রে আছে ধরা হয়। ৯ম ও ৫ম স্থানকে কোণ বলে এবং ৬ষ্ঠ, ৮ম ও ৯ম স্থানকে দুঃস্থান বলে। গ্রহগণ জন্ম-লগ্নের কেন্দ্র ও কোণে বলশালী হয় এবং শুভ ফল প্রদান করে কিন্তু দুঃস্থানে অশুভ ফল প্রদান করে। জন্ম-রাশি বা জন্ম-লগ্নকে ১ম স্থান ধরে অবশিষ্ট রাশিগুলোকে ২য়, ৩য়, ৪র্থ এই ক্রমে গণনা করে শেষ পর্যমত্ম যে ১২টি স্থান পাওয়া যায় ঐ ১২টি স্থান দ্বারা ১২ প্রকার ভাব ফল নির্ণয় করা হয়। ১ম অর্থাৎ জন্ম-লগ্ন ও জন্ম-রাশি থেকে দেহভাব, ৩য় স্থান থেকে ভ্রাতৃভাব, ৪র্থ স্থান থেকে বন্ধুভাব, ৫ম স্থান থেকে পুত্রভাব, ৬ষ্ঠ স্থান থেকে শত্রুভাব, ৭ম স্থান থেকে পতি বা পত্নীভাব, ৮ম স্থান থেকে আয়ু বা নিধনভাব, ৯ম স্থান থেকে ভাগ্য বা ধর্মভাব, ১০ম স্থান থেকে কর্মভাব, ১১শ স্থান থেকে আয়ভাব এবং ১২শ স্থান থেকে ব্যয়ভাব বিচার করা হয়। যেমন- মেষ রাশি বা মেষ লগ্নের ৭ম স্থানে তুলা রাশি অবস্থিত। ৭ম স্থান দ্বারা পতি বা পত্নীযোগ, বিবাহ ও দাম্পত্য-জীবন বিচার করা হয়। এখন মেষ রাশির ৭ম স্থানে অর্থাৎ তুলা রাশিতে যদি শুভ, উচ্চস্থ ও মিত্র গ্রহ অবস্থান করে এবং শুভ গ্রহের দৃষ্টি থাকে তবে ঐ জাতকের পতি বা পত্নী, বিবাহ ও দাম্পত্য-জীবন সুন্দর হবে। এর বিপরীত হলে বিপরীত ফল প্রসব করবে। এভাবে দ্বাদশ স্থানে গ্রহ-নক্ষত্রে অবস্থান অনুসারে দ্বাদশ প্রকার ভাব বিচার করা হয়। দ্বাদশ স্থানের অধিপতি গ্রহের অবস্থান অনুসারেও দ্বাদশ ভাব নির্ণয় করা হয়। যেমন- মেষ রাশির অধিপতি মঙ্গল তাই মঙ্গল হবে লগ্নপতি। মেষ রাশির ২য় স্থানে বৃষ রাশি রয়েছে। বৃষ রাশির অধিপতি শুক্র তাই শুক্র হবে তনুপতি। এই শুক্রের শুভ বা অশুভ দ্বারা তনু বা দেহভাবের শুভাশুভ বিচার করা হয়।
যাত্রা প্রকরণ
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে রবি ও শুক্র বার পশ্চিমে, মঙ্গল ও বুধ বার উত্তরে, শনি ও সোম বার পূর্বে এবং বৃহস্পতি বার দক্ষিণে দিকশূল হয়। তাই উক্ত বারে উক্ত দিকে যাত্রা অশুভ। শুক্লা-প্রতিপদ, চতুর্থী, ষষ্ঠী, অষ্টমী, নবমী, দ্বাদশী, অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে যাত্রা করলে অশুভ হয়।অশ্বিনী, হস্তা, পুষ্যা, অনুরাধা, পুনর্বসু, রেবতী, জ্যেষ্ঠা ও মৃগশিরা নক্ষত্রে যাত্রা উত্তম। রোহিণী, পূর্ব-ফাল্গুনী, পূর্বাষাঢ়া, পূর্ব-ভাদ্রপদ, চিত্রা, স্বাতী, শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, ও শতভিষা নক্ষত্রে যাত্রা মধ্যম। উত্তর-ফাল্গুনী, উত্তরাষাঢ়া, উত্তর-ভাদ্রপদ, বিশখা, মঘা, আর্দ্রা, ভরণী, অশেস্নষা ও কৃত্তিকা নক্ষত্রে যাত্রা শুভ। শ্রবণা ও জ্যেষ্ঠাতে পূর্বদিকে, পুষ্যা ও রোহিণীতে পশ্চিম দিকে, হস্তা ও উত্তর-ফাল্গুনীতে উত্তর দিকে এবং পূর্ব-ভাদ্রপদ ও অশ্বিনীতে দক্ষিণ দিকে নক্ষত্রশূল হয়। উক্ত নক্ষত্র যে দিন থাকে সে দিন উক্ত দিকে যাত্রা অশুভ। রবি পূর্বদিকের, চন্দ্র বায়ুকোণের, মঙ্গল দক্ষিণদিকের, বুধ উত্তরদিকের, বৃহস্পতি ঈশানকোণের, শুক্র অগ্নিকোণের, শনি পশ্চিমদিকের, রাহু নৈর্ঋতকোণের অধিপতি। বুধ ভিন্ন দিকপতির দিনে যাত্রা শুভ। প্রতিপদ ও নবমীতে পূর্বদিকে, তৃতীয়া ও একাদশীতে অগ্নিকোণে, পঞ্চমী ও ত্রয়োদশীতে দক্ষিণদিকে, চতুর্থী ও দ্বাদশীতে নৈর্ঋতকোণে, ষষ্ঠী ও চতুর্দশীতে পশ্চিমদিকে, সপ্তমী ও পূর্ণীমাতে বায়ুকোণে, দ্বিতীয়া ও দশমীতে উত্তরদিকে এবং অষ্টমী ও অমাবশ্যাতে ঈশানকোণে যোগিনী বাস করেন। যাত্রায় যোগিনীর শেষ নয় দণ্ড পরিত্যাজ্য। দক্ষিণ ও সম্মুখস্থ যোগিনীতে যাত্রা অশুভ এবং বাম ও পৃষ্ঠে অবস্থিত যোগিনীতে যাত্রা শুভ।
বিবাহের কাল বিচার
জ্যোতিষ শাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে, সপ্ত বারের মধ্যে সোম, বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার বিবাহে প্রশস্ত। রবি, মঙ্গল ও শনি বারে বিবাহ হলে কন্যা কুলটা হয়। অমাবস্যা ও রিক্তায় (৪র্থী, ৯মী ও ১৪শী) বিবাহ অশুভ। তবে শনি বার রিক্তা তিথিতে বিবাহ শুভ। রেবতী, উত্তর-ফাল্গুনী, উত্তরাষাঢ়া, উত্তর-ভাদ্রপদ, রোহিণী, মৃগশিরা, মূলা, অনুরাধা, মঘা, হস্তা ও স্বাতী এই সব নক্ষত্রসমূহে বিবাহ শুভ। ব্যতীপাত, পরিঘ, বৈধৃতি, অতিগ-, ব্যাঘাত, হর্ষণ, শূল, গ-, বিকুম্ভ এবং বজ্র যোগ ভিন্ন অন্নযোগে বিবাহ প্রশস্ত। শকুনি, চতুষ্পাদ, নাগ, কিন্তঘ্ন ও বিষ্টি করণে বিবাহ নিষিদ্ধ। বারটি মাসের মধ্যে মাঘ, ফাল্গুন, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও অগ্রহায়ণ মাসে বিবাহ প্রশস্ত। তবে অরক্ষণীয়া কন্যার নক্ষত্রে পৌষ ও মাঘ মাসেও বিবাহ প্রশসত্ম। লগ্নের ক্ষেত্রে কন্যা, তুলা, মিথুন ও ধনু লগ্নের পূর্বাংশে বিবাহ শুভ। বিবাহের সময় লগ্ন, ৫ম, ৯ম ও ১০মে বৃহস্পতি থাকলে সুতহিবুক যোগ হয়। গর্গমুনির মতে জন্মদিনে কন্যার বিবাহ নিষিদ্ধ তবে জন্ম-মাসে বিবাহ প্রশস্ত। জন্মদিনের পর আট দিন পরিত্যাগ করে কন্যার বিবাহের বিধান আছে। কন্যার ক্ষেত্রে জন্মবার, জন্ম-নক্ষত্র ও জন্ম-রাশিতেও বিবাহ প্রশস্ত। জ্যৈষ্ঠ ও অগ্রহায়ণ মাসে জ্যেষ্ঠ পুত্র বা কন্যার বিবাহ নিষিদ্ধ। তবে জ্যৈষ্ঠ মাসের দশ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর বিবাহ প্রশস্ত। জন্মদিন, জন্ম-বার, জন্ম-মাস, জন্ম-নক্ষত্র ও জন্ম-রাশিতে পুরুষের বিবাহ নিষিদ্ধ। সুতহিবুক যোগে লগ্নের গ্রহসংস্থান জনিত সকল দোষ নাশ হয়। এখন গোধুলি লগ্ন প্রসঙ্গে আসা যাক। যে সময় শুভ লগ্ন থাকে না আবার বিবাহ-কার্যও আবশ্যক হয়ে পড়ে তখন গোধুলি লগ্নে বিবাহ প্রশস্ত। গোধুলি লগ্নে বিবাহে বার, তিথি, নক্ষত্র, বিষ্টিভদ্রা প্রভৃতি দোষ থাকলেও বিবাহ অশুভ হয় না। বিবাহের প্রশস্ত মাসের মধ্যে অগ্রহায়ণ ও মাঘ মাসে এবং শনি ও বৃহস্পতি বার গোধুলি লগ্নে বিবাহ নিষিদ্ধ।