বাংলাদেশের বিবিসি বাংলা জানান: পঞ্চগড়ের জেলা কারাগারে পলাশ কুমার রায় নামের এক ব্যক্তির গায়ে আগুন লাগার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
গত ২৬শে এপ্রিল পঞ্চগড়ের ওই কারাগারে অগ্নিদগ্ধ হন পলাশ কুমার রায়, যিনি পেশায় একজন আইনজীবী ছিলেন।
অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর ৩০শে এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
কারাগারের মতো একটি সুরক্ষিত স্থানে একজন বন্দীর গায়ে আগুন লাগার ঘটনা এই মধ্যে বেশ আলোড়ন তুলেছে।
এই ঘটনায় সায়েদুল হক সুমন নামের একজন আইনজীবী আদালতে বাদী হয়ে একটি রিট দায়ের করেন হাইকোর্টে।
কারাগারের ভেতরে একজন মানুষের শরীরে আগুন লাগার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কীভাবে পৌঁছালো এবং কারাগারে অবস্থানরত ব্যক্তির নিরাপত্তা দিতে কারা কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা কেন অবৈধ বলে ঘোষণা করা হবে না – রিটে মূলত সেই প্রশ্নই তুলেছেন সায়েদুল হক সুমন।
ওই রিটের প্রেক্ষিতে ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
কেন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন পলাশ রায়?
পলাশ রায়ের ভাই প্রবীর কুমার রায় বিবিসি বাংলাকে জানান, প্রধানমন্ত্রীকে কটুক্তি করার অভিযোগে ২৬শে মার্চ পলাশ রায়কে আটক করে জেল হাজতে পাঠায় পঞ্চগড় পুলিশ।
তবে প্রধানমন্ত্রীকে কটুক্তি করার মামলাটি সাজানো ছিল বলে দাবি করেন প্রবীর কুমার রায়।
তিনি বলেন, “আমার ভাই একটি রাসায়নিক তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানের আইনি কর্মকর্তা ছিলেন। ২০১৬ সালে ঐ প্রতিষ্ঠান তার নামে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে।”
তিনি আরও জানান, “এ বছরের ২৫শে মার্চ ওই ঘটনার প্রতিবাদে সে (পলাশ রায়) একটি মানববন্ধন করে এবং প্রধানমন্ত্রীর বরাবর একটি স্মারকলিপি জমা দেয়ে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসকের অফিসে।”
এর পরদিনই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কটুক্তি করার অভিযোগে তাকে আটক করে জেল হাজতে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানান প্রবীর রায়।
পরিবার যেভাবে জানতে পারলো অগ্নিকান্ডের ঘটনা
পলাশ কুমার রায়ের মা মীরা রানী রায় বিবিসিকে জানান, পলাশ রায়ের গায়ে আগুন লাগার ঘটনা ঘটার দিন জেল হাজতে পলাশের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, “২৬ তারিখ জেল হাজতে দেখা করতে গিয়ে আমি দেখি সেখান থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স বেরিয়ে যাচ্ছে। পরে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি যে পলাশের গায়ে আগুন লেগেছে, তাই তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।”
এরপর পঞ্চগড়ের ওই হাসপাতালে গেলেও পলাশকে দেখতে অনুমতি দেয়া হয়নি তাকে, বলছেন তিনি।
মীরা রায় আরও অভিযোগ করে বলেন, “পঞ্চগড়ের হাসপাতাল থেকে আমার ছেলেকে রংপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি ভেবেছিলাম তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কিন্তু আমি রংপুরে গিয়ে দেখতে পাই তাকে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একটি বেডে ফেলে রেখেছে।”
তবে রংপুরের কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার রত্না রায় বিবিসি বাংলাকে বলেন, পলাশ রায়কে নিয়ম অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
মিজ রায় বলেন, “তাকে (পলাশ রায়) যথাযথ চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এখানে সমন্বয়ের কোনো অভাব ছিল না এবং কারো কোনো গাফিলতিও ছিল না।”
পলাশ রায়ের শেষ জবানবন্দি
হাইকোর্টে যিনি রিট করেছেন, সেই আইনজীবী সায়েদুল হক সুমন জানিয়েছেন যে অগ্নিদগ্ধ হওয়া পলাশ রায়ের একটি জবানবন্দি তার মৃত্যুর আগে হাসপাতালে রেকর্ড করা হয়েছিল এবং ওই জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে ঘটনাটিকে হত্যা বলে সন্দেহ করে আদালতে আবেদনটি করা হয়েছে।
ওই জবানবন্দিতে দেয়া পলাশ রায়ের বক্তব্য উদ্ধৃত করে সায়েদুল হক সুমন বলেন যে জেল হাজতে দু’জন ব্যক্তি তার গায়ে কোনো তরল পদার্থ ছিটিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
পলাশের মা মীরা রায় বিবিসিকে বলেন, ২৬শে এপ্রিল গায়ে আগুন লাগার আগের দু’দিন তিনি যখন পলাশের সাথে দেখা করতে যান, তখন পলাশ তাকে জানায় যে ঢাকা থেকে তিনজন ব্যক্তি তার সাথে দেখা করেছে এবং তাকে মানসিকভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে।
তবে কথিত ওই তিন ব্যক্তি কারা বা তাকে কেন চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছিল, সে ব্যাপারে পরিবারের সদস্যরা ঠিক নিশ্চিত নন।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত
আইনজীবী সায়েদুল হক সুমন বলেছেন যে হাইকোর্ট পঞ্চগড়ের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দিয়েছে। এই কমিটিতে থাকবেন পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক, জেল সুপার এবং পুলিশ সুপার। একজন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কমিটিকে সহায়তা করবেন।
আগামী ৩০ দিনের মধ্যে এ ব্যাপারে প্রতিবেদন দিতে কমিটিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।